ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল!
নাসিমুজ্জামান সুমন : ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সাবেক ছিটমহল বিনিময়ের পর নয়শর বেশি মানুষ ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে মূল ভূখ-ে চলে গিয়েছিলেন। তাদের একটা বড় অংশই এখন ভাবছেন, ভারতে চলে আসার সিদ্ধান্ত হয়তো ভুল ছিল। তাদের অভিযোগ, যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার প্রায় কিছুই পূরণ করেনি ভারত।
এক বছর আগে, ১ আগস্ট থেকে ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। তারমধ্যে ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতের সঙ্গে এবং ১১১টি ভারতীয় গ্রাম বাংলাদেশের অঙ্গ হিসেবে বিনিময় হয়। বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর যেসব মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন তারা নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র পেয়েছেন ঠিকই; কিন্তু জমির দলিল, রাস্তা, বিদ্যুৎসহ নাগরিকদের সব সুবিধাই প্রায় বঞ্চিত! উল্টো স্থানীয় রাজনীতির ফলে ঢুকে পড়েছে অশান্তি।
৫১টি ছিট মহলের প্রায় নয়শ মানুষের স্থায়ী বাসস্থান তৈরি না হওয়া অবধি রাখা হয়েছে কয়েকটি অস্থায়ী শিবিরে। সারি দেওয়া টিনের ঘরে খুব গরম বা বেশি ঠা-ায় থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরইমধ্যে কয়েকজন বৃদ্ধ গত শীতে ঠা-ায় কাবু হয়ে মারাও গেছেন। এছাড়া অস্থায়ী শিবিরগুলোতে যে পরিমাণ রেশন দেওয়া হয়, তাতে পরিবার চালানো প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে রোজগারের বন্দোবস্তও নেই তাদের। তাই বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ছিটমহল থেকে চলে আসার আগে জমি জায়গা বা গবাদিপশু বেচে দিয়ে যে টাকা আনতে পেরেছিলেন, তা দিয়েই সংসার চলছে তাদের।
পূর্বতন ভারতীয় ছিটমহল দহলা খাগড়াবাড়ীর লক্ষ্মী বর্মণ। তিনি বলেন, ‘ওখানে সাজানো সংসার নষ্ট করে দিয়ে চলে এলাম। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুইতো পেলাম না। যদি সরকার কিছু না দিতে পারে, তাহলে আমাদের ফেরত পাঠিয়ে দিক।’
লক্ষ্মী বর্মণেরই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম হলদিবাড়ি শিবির অথবা দিনহাটা শহরের অস্থায়ী শিবিরের আরও অনেকের কাছেই। হলদিবাড়ির হরি বর্মণ, সন্তোষ রায়, মানিক হেমব্রম অথবা দিনহাটার মুহম্মদ উমর ফারুক, কাচুয়া বর্মণরা বলছিলেন, ভারত সরকার যদি প্রতিশ্রুতি পালন করতে না পারে, তাহলে যেন বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে নাগরিকত্ব যদি না-ও পাওয়া যায়, কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করে নেবেন তারা। ভারতের মূল ভূখ-ে চলে আসার সিদ্ধান্তটা হয়তো ভুলই ছিল বলে মনে হতে শুরু করেছে তাদের। অস্থায়ী শিবির থেকে কবে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে, সেটাও বুঝতে পারছেন না এখানকার বাসিন্দারা। আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই বা কি হবে, সেটাও অজানা।
পূর্বতন বাংলাদেশি ছিটমহল কিসমাত বাত্রিগাছের বাসিন্দা আঞ্জুয়ারা বিবি বলেন, ‘সরকার মুরগির বাচ্চা দিয়েছে। প্রায় সাবাইকেই ভোটের কার্ড দিয়েছে। কিন্তু তাতেও বাবার নামের জায়গায় স্বামীর নাম লেখা হয়েছে। এরকম ভুল প্রায় সবার কার্ডেই। কিন্তু সরকার রাস্তা, বিদ্যুৎ, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সেচের ব্যবস্থা কিছুই করে উঠতে পারেনি। একই কথা বলছিলেন ওই গ্রামেরই বাসিন্দা অনিল বর্মণ, অনন্ত বর্মণরা। অথচ সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহল এই গ্রামে ঠিক এক বছর আগের এই দিনে কতই না আনন্দ হুল্লোড় হয়েছিল। ৩১ জুলাই ও পয়লা আগস্টের মাঝরাতে জাতীয় পতাকা উঠেছিল, ঘরে ঘরে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছিল, মিষ্টি বিতরণ হয়েছিল। পোয়াতুরকুঠি ছিটমহলের কয়েকজন বাসিন্দা নজরুল শেখ, হাশেম আলি, মুনাব আলি, নিরঞ্জন সরকার ও হেমন্ত বর্মণরা বলছিলেন, ‘সেদিন আনন্দ করেছিলাম। আর এখন তো নিরানন্দ। আগে পরিচয়পত্র ছিল না, কিন্তু গ্রামে শান্তি ছিল। এখন রাজনীতি ঢুকে পড়ে তো আমাদের হয়েছে জ্বালা।’
এক বছরে কী পেলেন? জানতে চাওয়ায় হলে পোয়াতুরকুটির এক বাসিন্দা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেই দিলেন, ‘এক বছরে জমির কাগজই পেলাম না, আর জানতে চাইছেন কী পেয়েছি?’
সাবেক ছিটমহলগুলোতে এখনও জমি জরিপ শুরু হয়নি। আর তার ফলে ছিটমহলগুলোর জমির মালিকানা এখন কারোরই নেই। সব জমিই স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী সরকারের হয়ে গেছে। আগে অর্থের প্রয়োজনে অন্তত জমি বন্ধক রাখা যেত, এখন সেটাও বন্ধ। তবে সাবেক ছিটমহলের একটা বিষয়ে যে পরিবর্তন হয়নি সেটা নিশ্চিত করে বলার জন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে হয় না।
গাঁজা গাছ!
অনেক বাড়িতেই যেমন আগেও গাঁজাচাষ হতো এখনও সেই গাছগুলো চোখে পড়ল। সাবেক ছিটমহলগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে কতটা নজরে আছে এটা তার একটা বড় প্রমাণ।
ভারতে যোগ দেওয়া সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলগুলো থেকে কেন এত অভিযোগ উঠছে? বিবিসি বাংলার প্রশ্নের জবাবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী এবং কোচবিহার জেলায় তৃণমূল কংগ্রেস দলের সর্বোচ্চ নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, ‘অভিযোগ তোলার জন্যই অভিযোগ করা হচ্ছে। বাইরের কিছু লোক গিয়ে ওদের উস্কাচ্ছে। সবে তো একবছর হয়েছে, তার মধ্যে ওরা ভোটাধিকার তো পেয়েছে। একশ দিনের কর্ম সুনিশ্চিতকরণ প্রকল্পের কার্ড পেয়েছে। আর কাজ করা সম্ভব কিভাবে হবে? তিনমাস ভোটের জন্য রাস্তা, বিদ্যুৎ কিছু করা যায়নি। তারপর চারমাস ধরে বর্ষা চলছে। কেন্দ্র থেকে ১৭০ কোটি টাকা এসেছে। বর্ষার পরেই কাজ শুরু হবে।’
সাবেক ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে যারা চলে এসেছেন তারা এখন ভাবছেন নিজেদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল কী না! তাদের অভাব-অভিযোগের প্রেক্ষিতে মন্ত্রী বলেন, ‘আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া হবে, এরকম ঘোষণা কোথাও করা হয়নি। ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আমরা করব। শিবিরগুলোতে ওদের জন্য অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অধৈর্য হলেতো হবে না। সময় দিতে হবে।’
সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দারা হয়তো অপেক্ষা করবেনই। নাগরিকত্বহীন, পরিচয়হীন অবস্থাতেও ৬৮ বছর অপেক্ষা করেছেন তারা। স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারতের পার্লামেন্টে অনুমোদিত হওয়ার জন্যও তো তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় চার দশক। তাই অপেক্ষা করাটা হয়তো সাবেক ছিটমহলের মানুষের জীবনের অঙ্গই হয়ে গেছে এখন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।