গোয়েন্দা সফলতা-ব্যর্থতা এবং আরও কিছু প্রশ্ন
হাবিবুর রহমান তাপস
একটি রাষ্ট্রের চোখ ও কান হচ্ছে তার নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সংস্থার ভুলের কারণে কি ঘটতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ধ্বংস ও পরাজিত হয়ে সেটি প্রমাণ করেছে। নাজি পার্টির নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা নাজী সিক্রেট সার্ভিস ‘এসডি’র সঙ্গে জার্মানি সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ‘এপভেয়র’ এর দ্বন্দ্ব ছিল চরম পর্যায়। একে অপরের বিরুদ্ধে এতটাই সক্রিয় ছিল যে সামরিক গোয়েন্দা প্রধান এডমিরাল ক্যানারিকে যুদ্ধের শেষ পর্যায় হিটলারের আদেশে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। ৯/১১ এর সময় আমেরিকান গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার পর গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ নতুন করে সংগঠিত করা হয়। তাদের ১৬টি গোয়েন্দা সংস্থা বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই গুপ্তচর প্রথা চালু ছিল। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ দেখা যায়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের জন্যে দূত ও নিজ দেশের নিরাপত্তার প্রয়োজনে তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য ‘চর’ নিয়োগ করা হতো। এরা বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা পাবার জন্য শত্রুর দেশ থেকে এবং নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ তথ্য সংগ্রহ করত।
রাজ্য শাসনের ভার রাজার হাতে থাকে। সুশাসন বজায় রাখতে সবকিছুর ওপর রাজার নিয়ন্ত্রণ থাকা চাই। তাই সর্বদা তাকে সজাগ থাকতে হয়। রাজার মাথা থাকবে সবার উপরে। তা না হলে, রাজধানীতে বসে দেশের অন্য প্রান্তে কি ঘটছে সেটি দেখার উপায় কি? তার রাজ্যের শাসনতন্ত্র সুশৃঙ্খলভাবে বলবৎ রাখতে তার কঠোর নীতির প্রচারটা জরুরি। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, একা সকলের ঊর্ধ্বে মস্তক আপন যদি না রাখিবে রাজা/যদি বহুজন বহুদূর হতে তার সমুদ্ধত শির নিত্য না দেখিতে পায় অব্যাহত স্থির/তবে বহুজনÑ ‘পরে বহুদূরে তার কেমনে শাসনদৃষ্টি রহিবে প্রচার? (কবিতা : গান্ধারীর আবেদন)
ভারতবর্ষে পুরাতন একটি কথা চালু আছে, রাজা তার কান দিয়ে দেখেন। যেহেতু রাজার একার পক্ষে দেশের সব অঞ্চলের অবস্থা চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব নয়, তাই তাকে এই ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের ওপর নির্ভর করতে হয়। যারা এই কাজে লিপ্ত আছেন তারা অনেক সময় রাজার আনুকূল্য পাবার জন্য সঠিক তথ্য প্রদর্শন না করে রাজার পছন্দ মাফিক দিলখুশ তথ্য দিয়ে রাজাকে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। এই কান দিয়ে দেখার পদ্ধতিটাই হচ্ছে, ‘ইন্টেলিজেন্স মেথডোলজি’। তথ্যের সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করার মতো জ্ঞান ও দূরদর্শিতা বুদ্ধিমত্তা থাকাটা রাজার যোগ্যতা।
মাওসেতুং এর কমিউনিস্ট পার্টি দেশ ও সমাজের তথ্যাদি নিচু স্তর থেকে উঁচু স্তরের মাধ্যমে তথ্যাদি সংগ্রহের পদ্ধতি চালু ছিল। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এম টি রামারাও রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি শুধু গোয়েন্দা তথ্যাদির ওপর নির্ভর করতেন না, নিজেও প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকাগুলো পড়তেন। খুব ভোরবেলা তিনি ধর্মীয় উপাসনা শেষে রাজ্যের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে চোখ রাখতেন। এরপর বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি রাজ্য পরিচালনার দাপ্তরিক কাজে মনোনিবেশ করতেন। তিনি জানতেন, রাজ্যের সাধারণ মানুষের খোঁজ রাখতে দৈনিক পত্রিকার খবরের বিকল্প নেই।
কথিত আছে, আমাদের সাবেক বিরোধিদলীয় নেত্রী যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন গোয়েন্দা দফতর থেকে আসা জাতীয় দৈনিকের নির্দিষ্ট কিছু পত্রিকার বাছাই করা খবরকে তিনি গুরুত্ব দিতেন। সেটির বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই-বাছাই করবার জন্য পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত অনুশীলনের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে বক্তৃতা বিবৃতি দিতে গিয়ে তথ্য উপাত্তের অপ্রতুলতার জন্যে তাকে অনেকসময় দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অনেক বেলা করে শয্যা ত্যাগ করতেন, এটি তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নিজেকে দাপ্তরিক কাজের জন্য প্রস্তুত করতে তিনি অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলতেন, দৈনিক পত্রিকা পড়বার মতো সময় তার হাতে থাকত না। তার শাসনামলে ‘হাওয়া ভবন’ নিয়ে সারাদেশব্যাপী যে গুঞ্জন ছিল, সেই সম্পর্কে তৎকালীন তার অধীনস্ত গোয়েন্দারা কি তাকে কোনো প্রকার সতর্কতামূলক সংকেত দেখাননি? যদি দেখিয়ে থাকে, তবে সেই গোয়েন্দা রিপোর্টকে তিনি গুরুত্ব না দিয়ে ভুল করেছেন। আর যদি তিনি কোনো ধরনের সংকেত না পেয়ে থাকেন তবে তা গোয়েন্দা ব্যবস্থাপনার ত্রুটি। কারণ ওই সময়ে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মুখে মুখে ছিল হাওয়া ভবনে বসে তার পুত্রের অপকীর্তির কথা, কিন্তু তা তার কানেই পৌঁছাল না এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি ব্যর্থ হলেন কীভাবে?
দেশের গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভুল তথ্য যেমন দেশ ও জাতিকে রক্ষা করে, তেমনি ভুল তথ্য শাসকগোষ্ঠীর পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিককালে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের আগাম তথ্যে কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের চৌকষ কাউন্টার টেরোরিজম দল হানা দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে জঙ্গিদের বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করেছে। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘটানো ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার খবর আগাম না জানার ব্যর্থতার কারণে ২১ জন মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। ওই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন, শেখ হাসিনাসহ অনেক নেতাকর্মী। এটা কি পুরোপুরি গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল?
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, জাবি
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন