ধ্বংসাত্মক মূল্যবোধ
মূল্যবোধ শব্দটি বৃহৎ পরিসরে ব্যবহৃত একটি শব্দ। শুরুরটাই হলো পারিবারিক মূল্যবোধ। পরিবারেরকে, কে কিভাবে তা শুরু করবে বা শেখাবে তার কোনো গাণিতিক নিয়ম নেই। আপনি, আমি পরিবারের ভেতর থেকে, নিজের অবস্থান থেকে স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন সকলের পরিবারে এর পরিচালন করা সম্ভব। একই পরিবারে থেকে আপনি পরিবারের অন্য সদস্যদের কিভাবে দেখছেন, কেমন যোগাযোগ রক্ষা করছেন, কি ধরনের আলোচনা সমালোচনা করছেন, কি ধরনের আচরণ প্রকাশ করছেন তা পরিবারের ছোট সদস্য বা শিশুরা খেয়াল করছে, অনুকরণ-অনুসরণ করছে। আপনার বাকভঙ্গি, শিষ্টাচার, পোশাক-পরিচ্ছদ, নির্দেশনা, সতর্কতা, সহমর্মিতা, স্নেহ-ভালোবাসা সবকিছু পারিবারিক মূল্যেবোধের মধ্যে পড়ে এবং এর প্রভাব ব্যক্তি জীবনে প্রত্যেকের মধ্যে প্রকট-প্রচ্ছন্ন রূপে দেখা দেয়।
পারিবারিক মূল্যেবোধের সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যেবোধ পুরো অংশ জুড়েই সম্পৃক্ত। ধর্মীয় মূল্যেবোধ হলোÑ বিশ্বাসের চর্চা। বিশ্বাসকে ধ্বংস করে কুসংস্কার নামে একটি নষ্ট শব্দ। এই মূল্যেবোধ পরিবারের মধ্যে থেকে নির্মিত একটি অবকাঠামো। এ অবকাঠামোর ভিত যত শক্ত হবে ততই মানবতার উন্নয়ন হবে। যে পরিবারের সন্তানটি ধর্মীয় অনুশাসনকে, রীতি রেওয়াজকে অবহেলার চোখে দেখে, এড়িয়ে চলে, সে যদি কখনও হঠাৎ করে সেই অনুশাসনকে তার জীবনের আবাস মনে করে, তখন সে হবে ধ্বংসাত্মক মূল্যেবোধের অনুশাসক। পারিবারিক মূল্যবোধ না থাকাই এর জন্য দায়ী। ধরুন, যিনি তথাকথিত আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, অর্থ উপার্জনের নেশায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন, ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে পারিবারিক মূল্যেবোধের অবনমন করেছেন, বিলাসিতার নামে হাল ফ্যাশনে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন, রঙ্গমঞ্চের একাংশ নিজ গৃহে বসিয়েছেন, অর্থ অলংকারে সহধর্মীনির শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছেন, সন্তানদের নাম করা স্কুল, টিউটর, গাড়ি, ব্র্যান্ড শপিং আর রসনা বিলাসে ডুবিয়ে রেখেছেন; তিনি কি কখনও কোনো মূল্যেবোধ নিশ্চিত করতে পারবেন? উত্তরটা খুব সহজ। না, পারবেন না। তাই বলে কি এসবের মধ্য দিয়ে মূল্যবোধের চর্চা করা যাবে না? করা যাবে। শুধু পরিবর্তন করতে হবে ‘এটিচ্যুড’।
বর্তমান সময়ে নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে মূল্যেবোধ শব্দটির ব্যাপক অবক্ষয় ঘটেছে। চলুন, একদিন ঢাকা শহরের নামী-দামী কোনো হোটেলে। এত সস্তা সঙ্গ আর তথাকথিত আধুনিকতা, উশৃঙ্খলতা, কোথাও দেখবেন না। যারা করছেন তারা সকলেই এ দুই স্তরের। আবার যারা সেখানে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন তারা কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের। এর ফলে পরিবারে ও সমাজে যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তেমনি ব্যক্তি ও পরিবারের উন্নয়নও হতে পারে। তবে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো কোনটির প্রভাব বেশি। নেতিবাচক প্রভাব বেশি হলে তা হবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
এবার, একটু ডাউন টাউন কিংবা আদি নিবাস গ্রামে ফিরে যাই। সেখানেও দেখবেন তারা যেন তথাকথিত আধুনিক হয়ে উঠেছে, তাদের চলাফেরায়, কাজে-কর্মে শালীনতা শব্দটি যেন নির্লিপ্ত, উপার্জনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সবাই যেন মত্ত। এ ধরনের হঠাৎ কর্ম তৎপরতা বৃদ্ধিও অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী কোনো সফলতা আনবে না। আদিকাল থেকেই হেরেমবিলাস নারী-পুরুষের বিনোদনের অন্যতম স্থান। আদিকালে যখন পরিবার ছিল না, তখন মানুষ দলে বাস করত, আর হেরেমবিলাসেরও কোনো সুযোগ ও প্রয়োজন ছিল না। যখন পরিবার সৃষ্টি হলো, পারিবারিক মূল্যবোধ তৈরি হলো তখন থেকেই হেরেমবিলাসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। সে জন্য বর্তমান সময়ে হেরেমবিলাসকে অপ্রয়োজনীয় বললে অনেকে অখুশি হবেন। তবে তিনি পারিবারিক মূল্যবোধটি বজায় রেখেছেন কিনা সেটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
আবার আধুনিকতা পরিবর্তনের একটি অংশ। তবে এই ‘আধুনিক’ হওয়ার অর্থ ভোগ বিলাস নয়, পোশাকের পরিবর্তন নয়, রাতের জীবনে অভ্যস্থ হওয়া নয়, সুন্দর করে ভাঙা ইংরেজিতে কথা নয়, যন্ত্র নির্ভর সংগীত পরিবেশন নয়। আধুনিকতা হলো মানসিকতার পরিবর্তন, রুচির পরিবর্তন, ধর্মীয় চেতনার পরিবর্তন, শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ সাধন। অর্থাৎ সামাজিক মূল্যবোধটাও অত্যন্ত জরুরি।
মূল্যবোধ যেন এখন মধ্যবিত্তদের ভূষণ। এ শ্রেণিটাই হয়তো মূল্যেবোধ শব্দটার বর্তমান ধারক ও বাহক। এ শ্রেণির পরিবারে চলছে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যোবোধের চর্চা। সেটা যে কারণের হোক। বলতে পারেন তাদের সামর্থের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু চর্চা তো চলছে। তারা তো পরিবারের নিকট তাদের সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন, সন্তানদের বাস্তবতা শেখাচ্ছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ মেনে চলছেন। আমরা এখন আর কেউ মূল সংস্কৃতির দিকে তাকাই না। সমাজের একটা অংশ হয়েছে অনেকটা ভালো জাতের সায়ন স্থানীয় জাতের সঙ্গে গ্রাফটিং করার মতো। ভালো ফল হয়তো পাওয়া যাবে কিন্তু তা হবে ক্ষণস্থায়ী। যেমনটা ঘটেছে এ সমাজের নিম্ন ও উচ্চ স্তরের পরিবারগুলোতে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গুলশান ট্র্যাজেডি, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের ঘটনা আমাদের সংকিত করেছে। তাদের জীবনবৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করলেই পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি তাদের ‘এটিচ্যুড’ অনুধাবন করা যায়। আর সেজন্যই তাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া মূল্যবোধ হয়ে উঠেছিল ধবংসাত্মক।
লেখক : অ্যাডিশনাল এসপি, এসপিবিএন / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন