ধর্মের অস্তিত্ব সংকটে মুক্তচিন্তার তারুণ্য
নিয়ন মতিয়ুল
বিশ্বরাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ধর্ম আর ধর্মীয় চেতনাকে খুব বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক ভূমিকা সেটাই প্রমাণ করে। প্রতিদিন ঝরছে রক্ত, বাতাসে ভাসছে আর্তনাদ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নগরীগুলো।
সুদূর কিংবা নিকট অতীতেও যে এমন বর্বরতা-নৃশংসতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি তা কিন্তু নয়। তবে এটাকে ধর্মকেন্দ্রিক আগ্রাসনই বলি কিংবা একমুখী বৈশ্বিককরণের ফলাফলই বলি না কেনÑ এ বর্বরতার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ধর্মীয় ছদ্মাবরণে যে শক্তির উত্থান হচ্ছে তা আরও ভয়াবহ। আবার সেই ভয়াবহতাকে দমানোর জন্য রাজনৈতিক যে কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে তা তো ভয়াবহতাকেও ছড়িয়ে যাচ্ছে।
জীবন নিয়ে অনন্ত জিজ্ঞাসা আর তার পরিণতি স্বরূপ যে ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের মননে-মগজে গেঁথে গেছে তা থেকে বেরুনোর পথ খোঁজার বিষয়টি যৌক্তিক বোধের ওপর নির্ভরশীল। তবে বাস্তবতার নিরিখে শান্তির পথ তৈরি করতে রাজনৈতিক সহনশীলতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব নেতাদের মধ্যে এ উপলব্ধির উদয় না হলে সামনের পথ আরও অনিশ্চিত অন্ধকার হয়ে উঠবে।
ধর্মগুরু তথা প্রচারকরা বলছেন, মানুষের তৈরি জীবন বিধান মানবসমাজের জন্য পূর্ণাঙ্গ নয়। এটা প্রণিধানযোগ্য সত্য হিসেবে মানা হলে রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্ন সামনে চলে আসে। যা সর্বজনীন সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে অন্তরায় বলেই মনে করা হয়।
পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জাতিরাষ্ট্র কিংবা জাতীয়তাবাদের সরলরেখায় থাকা এই রাষ্ট্রধর্ম সর্বজনীন সমাজের অন্তরায় হয়ে ওঠার কারণেই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর সে কারণেই প্রশ্ন উঠছে, শুধুমাত্র পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই জঙ্গিবাদের যুদ্ধ নাকি ধর্মভিত্তিক শান্তিপূর্ণ পরাক্রমশালী রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে তাদের এ লড়াই?
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের বিষয়টি সত্যি হলে বলা যেতে পারে, ধর্মের অস্তিত্ব সঙ্কটই এখন বড় প্রশ্ন জঙ্গিবাদীদের কাছে। অন্য ধর্মকে নগ্নভাবে আক্রমণ কিংবা নির্মূল করার ছক, নিজ ধর্মকে সেরা, সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ হিসেবে দাবি ও বিশ্বাস করাই তার বড় প্রমাণ। বর্বরতার প্রশ্নের জবাব বর্বরতায় দেওয়ার রীতি আদিম। পিছনে ফিরে তাকালে আবারও সেই প্রাচীন প্রশ্নটি সামনে আসে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি রক্তপাতের ঘটনা খাদ্য, বাসস্থান আর আবাসভূমি দখলের জন্য হয়েছে নাকি ধর্ম বিস্তার আর উন্মাদনায়?
পশ্চিমা বিশ্ব আর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের মতো উন্নয়নশীল তথা উন্নয়নকামী দেশগুলোর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ব্যবধান অনেক। তা সত্ত্বেও জঙ্গিবাদ বিস্তারের বাস্তবতার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করেই জঙ্গিবাদের স্বরূপ বুঝতে হবে আমাদের। আর সেই বাস্তবতা থেকেই কৌশল প্রয়োগ করতে হবে তা মোকাবিলায়।
বিশ্বের অন্যতম ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদের দেশ হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানের (বর্তমানে ‘অকার্যকর’ দেশ হিসেবে মনে করেন অনেকেই) রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দুই যুগব্যাপী বাঁধা ছিল বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান)। সাড়ে চার দশক আগে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মৌলবাদী নেতারা কিন্তু রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে শক্তি প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে তারা অভিযুক্ত হলেও তাদের বিচার ঝুলেছিল দীর্ঘদিন।
জাতীয়তাবাদী ডানপন্থিদের শাসনামলেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ শক্তি অর্জন করে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়ায়। তবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পরে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিদের বিচারের আওতায় আনা ও রায় ঘোষণা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর এ পরিস্থিতিতেই অস্থির হয়ে ওঠে রাজনীতি। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে দেশিয় আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই জঙ্গিবাদ বিস্তারের বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে আগামীর স্বপ্নভরা তারুণ্যের মুক্তচিন্তার পথ সুগম করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সাংবাদিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন