গুলশানের বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে মওদুদকে
এস এম নূর মোহাম্মদ : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ভাই মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন (নামজারি) করে ডিক্রি জারি করতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ওই বাড়ি নিয়ে দুদকের দায়ের করা মামলায় অভিযোগ আমলে নেওয়ার বৈধতা দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ ও তার ভাইয়ের করা আপিলও মঞ্জুর করেছেন আদালত। ফলে সে মামলাটিও বাতিল হয়ে গেছে।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউক ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল মঞ্জুর করে গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন। এই রায়ের ফলে মওদুদ আহমদকে গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ১৫৯ নম্বর প্লটের ওই বাড়ি হারাতে হচ্ছে। রাজউক এখন আইন অনুযায়ী বাড়িটি নিজেদের তত্ত্ববাবধানে নিবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। একইসঙ্গে এ বাড়িতে থাকা মওদুদের জন্য অবৈধ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মাহবুবে আলম বলেন, মওদুদ আহমদের ভাইকে উচ্ছেদের জন্য সরকার মামলা করেনি। মওদুদ আহমদের ভাই নিজেই মামলা করেছেন। কাজেই এখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও উদ্দেশ্য নেই। নিম্ম আদালতে তারা হেরে গিয়ে উচ্চ আদালতে এসেছেন। সেখানে মওদুদ আহমদরা জিতেছেন এবং হাইকোর্ট মওদুদ আহমদের ভাই মনজুর আহমদের নামে বাড়িটি নামজারি করতে রাজউককে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, হাইকোর্টের আদেশের পর আমি অস্ট্রিয়ায় যাই। সেখান থেকে বাড়ির মালিক অস্ট্রিয় নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর সনদ নিয়ে আসি। আমরা আপিল বিভাগে দেখাতে সক্ষম হয়েছি যে, মওদুদ আহমদের ভাই যে তারিখে চুক্তিনামা করেছিলেন, তার আগেই মারিয়া মারা গেছেন।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৩ সালে মওদুদ আহমদকে বাড়িটি দেখাশোনা করার জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন মারিয়া। কিন্তু তিনি তার ভাইয়ের নামে ডিক্রি ও মিউটেশনের (নামজারি) আদেশ নিয়ে নিয়েছেন। আজকে এ দুটি বিষয় আপিল বিভাগ বাতিল করেছেন। এর আগে এক বিঘা ১৩ কাঠা জমির উপর ওই বাড়ি অবৈধভাবে দখল ও আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর গুলশান থানায় মওদুদ ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে এই মামলা করে দুদক।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গুলশানের ওই বাড়ির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে এই বাড়ির মালিকানা এহসান পান। ১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। ওই বছর থেকেই মওদুদ পরিবার নিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, জিয়ার সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মওদুদ আহমদ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গুলশানের ওই বাড়ি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর ধারাবাহিকতায় মাত্র ১০০ টাকা মূল্য দেখিয়ে ১৯৮০ সালে প্লটটি তিনি বরাদ্দ নেন। পরে তিনি একটি বায়নানামা হাজির করেন, যেখানে দেখানো হয়, ওই বাড়ির মালিক ইনজে মারিয়া প্লাজ জনৈক মহসিন দরবারকে আমমোক্তার বানিয়েছেন এবং সেই মহসিন দরবার ১৯৮৫ সালে বাড়িটি মওদুদের সহোদর ভাই মনজুর আহমদের নামে বায়না করে দিয়েছেন।
তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ২৬ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দিলে ওই বছর ১৪ সেপ্টেম্বর বিচারক তা আমলে নেন। তবে মওদুদ ওই অভিযোগ আমলে নেওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন। শুনানি শেষে গত বছরের ২৩ জুন হাইকোর্ট তা খারিজ করে দেন। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ আপিলের আবেদন করলে আপিল বিভাগ তা মঞ্জুর করেন। এর ধারাবাহিকতায় আপিল বিভাগে মওদুদের আপিলের শুনানি হয়।
অন্যদিকে, মওদুদের এক আবেদনে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট হাইকোর্ট গুলশানের ওই বাড়ি তার ভাই মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন এবং ডিক্রি জারি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে রাজউক হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চাইলে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ তা মঞ্জুর হয়। এরপর চলতি বছর শুনানি নিয়ে আদালত বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। মঙ্গলবার দুটি বিষয়ের রায় একসঙ্গে ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল। অপরদিকে মওদুদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও মাহবুব উদ্দিন খোকন। এছাড়া মওদুদ নিজেও এ মামলায় শুনানিতে অংশ নেন। সম্পাদনা : পরাগ মাঝি