সুন্দরবন নিয়ে সরকার তার অসীম ক্ষমতা নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করবে কেন?
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
মানুষের, পরিবেশের, উদ্ভিদ জগতের ক্ষতি হবে তবুও সরকার ক্ষতিকর প্রজেক্ট নির্মাণ অব্যাহত রাখবে এমনটি তো ভাবাই যায় না। জনস্বার্থে আঘাত, সুন্দরবনের ক্ষতি হয় এমনটি নিশ্চিত হতে পারলে সরকার রামপাল বিদুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা জানি, সরকারের ক্ষমতা অসীম। কিন্তু সুন্দরবন নিয়ে সরকার তার এই অসীম ক্ষমতা নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করবে কেন? আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে সরকারের প্রতি এমন প্রশ্নই রেখেছেন সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম সামছুল আলম।
তিনি বলেন, সরকারের একটা অংশ বলছে, রামপাল বিদুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মোটেও কোনো ক্ষতি হবে না, অর্থমন্ত্রী সেই বিবেচনায় বলেছেন যে আদৌ ক্ষতি হবে না বা হলেও আংশিক ক্ষতি হবে। এরপরও যদি উনি বলে থাকেন আংশিক ক্ষতি হলেও সেখান থেকে সরকার নড়বে না, এমনটি তো কারও কাম্য নয়। একটি জনবান্ধব সরকারের কাছ থেকে এমনটি প্রত্যাশা করে না মানুষ।
তিনি আরও বলেন, সরকারই রাষ্ট্র চালায়। তাদের হাতে অনেক ক্ষমতা। রাষ্ট্র সেই ক্ষমতা কিভাবে কাজে লাগাবেÑ তারাই সেটা বিবেচনা করবে। তবে একটাই কথা আমার, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের কল্যাণে, জনগণের কল্যাণেই ব্যবহৃত হবে। সার্বভৌম ক্ষমতার তো কোনো সীমা নেই, সীমাবদ্ধতা নেই, অপরিসীম। রাষ্ট্রের সীমাহীন ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা যাতে রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে কাজে লাগে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুন্দরবন থেকে রামপাল বিদুৎকেন্দ্র ১৪ কিলোমিটার দূরে, তাহলে সুন্দরবন কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে? এই প্রশ্নটা করা খুবই সহজ। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে আপনি কয়লা পোড়াবেন, তাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না, আর চৌদ্দ কিলোমিটার পরে একটা বাউন্ডারি দিলেই ক্ষতিরোধ করা যাবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা কোনো প্রাণী নয় যে, আপনি একটি ওয়াল তুলে দিয়েছেন, সে আর তা ক্রস করতে পারবে না। রামপালে তো প্রতিরোধের কোনো বর্ম নেই। ওটা একটা বাধাহীন, উন্মুক্ত জায়গা। এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
ড. সামছুল আলম বলেন, সুন্দরবনের কারণে আশেপাশের এলাকা পরিবেশগতভাবে ক্রিটিক্যাল। সেখানকার ইকো সিস্টেম সংরক্ষণের জন্য স্বাভাবিক নগরায়নের কর্মকা- সেখানে চলে না। সেখানের নৈস্বর্গিক পরিবেশ বজায় রাখা দরকার পড়ে। এ ধরনের কার্যক্রম পরিবেশ বা সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কিনা তা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও গবেষণার দরকার ছিল এ ধরনের প্রজেক্ট নির্মাণের আগে।
তিনি আরও বলেন, সরকার সে ধরনের বিচার বিশ্লেষণ করেনি। এখন যখন যে প্রশ্ন উঠেছে, বিরোধীতা হচ্ছে প্রকল্পের, তখন সরকার থেকে বলা হচ্ছে, যে সমস্ত জায়গায় আপত্তি ছিল, আমরা সেসব জায়গা পরিবর্তন করেছি। তার মানে, সরকার শুরুতেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে না বুঝে হাত দিয়েছিল? এখনো এই বিষয়ে বুঝের জায়গায়টি সরকার পরিষ্কার হয়েছে বলে মনে হয় না। যারা এই প্রকল্পের বিরোধীতা করছে তার মধ্যে যথার্থতা আছে কি না, তা বিজ্ঞানভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করার জন্য যে ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ বা যে ধরনের ব্যক্তিদের কথাবার্তা আসা উচিত ছিল, তা আসেনি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা যে প্রশ্ন তুলেছিলাম, ইউনেস্কো থেকেও সেই একই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। তারা বলেছে, এই পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা তারা গ্রহণ করেনি। নৌপথে যে কয়লা আনা হবে, বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণ হওয়ার কারণে যে ধরনের দূষণ তৈরি হবে, সেই দূষণের পরিমাণ কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, দূষণ কতটুকু পরিবেশে গ্রহণযোগ্য হলে সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকারক হবে না এসব যাচাই-বাছাই করা দরকার ছিল, কিন্তু সেগুলো হয়নি। আমরা স্পষ্ট দেখছি, নদীগুলোর পরিবেশ এমন হয়ে গেছে যে, কুমির তার প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
সুন্দরবনে যে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিত বসবাস করছেÑ আস্তে আস্তে অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণীও বিলুপ্তি হয়ে গেছে। সুন্দরবন এখন একটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতি থেকে সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য আমাদের বিশেষভাবে তৎপর হওয়া দরকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সেই তৎপরতা তো রক্ষা করা যাচ্ছেই না, বরং এই প্রকল্প নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা সুন্দরবনের জন্য আরও ক্ষতিকারক হবে। এবং ক্ষতিকর দিকটি যথাযথভাবে যাচাই করা হয়নি বলেও মনে করেন সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির এই সদস্য।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন