আমাদের অলিম্পিক বাস্তবতা
শেখ মিরাজুল ইসলাম
ব্রাজিলের রিও অলিম্পিক অনেকগুলো বাধা আর কিন্তু পেরিয়ে তার মশাল জ্বালাতে যাচ্ছে। ভঙ্গুর অর্থনীতি কাঁধে নিয়ে রিও প্রস্তুত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞের। সেই মশাল কে জ্বালাচ্ছে বা কেন জ্বলছে সেই প্রশ্ন এখন অনর্থক। তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই অগ্নিস্নানে আমাদের মাতৃভূমির সম্মান কতটুকু শুচি-শুদ্ধ হতে পারবে। ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের ক্রীড়াবিদ বা আয়োজকগণ কেউ কথা রাখেননি। সাফ গেমস বা এশিয়াডে আশা জাগিয়েছিলেন কেউ কেউ, কিন্তু অলিম্পিকে প্রত্যাশার ধারে-কাছেও তারা কেউ ছিলেন না। ২০ কোটি মানুষের দেশে অলিম্পিকের শূন্য অর্জন সেই আপ্ত বাক্যটিই বড় সান্ত¡না হিসেবে আমরা দিনের শেষে মেনে নিই, জয় পরাজয় আসল কথা নয়, অংশগ্রহণ করাটাই মূখ্য।
আমাদের দেশে অলিম্পিক কমিটি নামের এক কেতাবি সংস্থা আছে। দারুণ সম্মানের আর বিনোদনের মাঝে তাদের বসবাস। ওই যে অংশগ্রহণই বড় কথা। তাই অলিম্পিক যাত্রার আগে মিডিয়ার সামনে হাসিমুখে কিছু আশার বাণী শোনানো ছাড়া তাদের বাড়তি কোনো দায় নেই। কি আর করা! ছেলেমেয়েগুলো হিটেই বাদ পড়ে গেলে তাদেরই বা কি করার আছে। কার্ল লুইস বা উসাইন বোল্ট বা ফেলপস্-এর জেনেটিক গড়ন আর আমাদের গ্রাম বাংলার অবকাঠামোয় বড় হওয়া শিরিন-সোনিয়া-মেজবাহ-মাহফিজুরের শারিরীক সক্ষমতা কি এক? আমাদের কি মার্কিনি বা ইউরোপিয়ান বা ক্যারিবিয়ান-অস্ট্রেলিয়ানদের মতো পুরো ৪০০ মিটার জুড়ে দৌড়ের আলাদা ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের বারো মাস অনুশীলনের অন্তত তেরটা স্টেডিয়ামের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা মজুত আছে? ইদানিং হোটেল, রিসর্টে ছোটখাটো সুইমিং পুল থাকলেও তা কি অলিম্পিক সাঁতারের অনুশীলনের জন্য যথেষ্ট? ডোবা-দীঘি-নদীতে সাঁতার কেটে অলিম্পিকে সোনা কেন তামাও আনা যাবে না সেটা বোঝার বুদ্ধি নিশ্চয়ই আমাদের ক্রীড়া কর্তৃপক্ষের আছে। নাকি মার্চ পাস্টে পা মেলানোতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ।
মোদ্দা কথা হলো, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ সাফল্যের চাবিকাঠি হচ্ছে ক্রীড়াবিদদের স্ট্যামিনা আর কৌশলের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিশ্রুতিশীল অ্যাথলেটের দেখা প্রাথমিক পর্যায়ে পাওয়া গেলেও তাকে গড়ে তোলার কোনো দীর্ঘমেয়াদী আয়োজন নেই। লাগাতারভাবে কেবলমাত্র সশস্ত্র বাহিনীর কোটায় ক্রীড়াবিদ ‘উৎপাদন’ কোনো আশার কথা নয়। সাধারণ সিভিল সোসাইটির ক্রীড়াবিদরা ন্যূনতম সুযোগ পান না বিধায় তিন বাহিনীর ‘সীমাবদ্ধ’ প্রশিক্ষণের সুযোগটাকেই অনেক বড় করে দেখা হয়। কিন্তু তা অলিম্পিক জেতার জন্য যে যথেষ্ট নয় তা গত চার দশকের রেকর্ড দেখলেই বোঝা যায়। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে কেবলমাত্র ক্যাডেট কলেজগুলোতে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের ইভেন্টগুলোর সঙ্গে হাতে-কলমে পরিচয় ঘটলেও তা আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার কোনো পরিকল্পনা নেই। শখের অ্যাথলেট হিসেবেই তারা হারিয়ে যায়।
এভাবে আর কোথাও তৃণমূল পর্যায়ে আগামী দিনের সফল অ্যাথলেট গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান ওই এক বিকেএসপি ছাড়া আর কোথাও নেই। এই চরম সত্যটা বোঝার পরও আয়োজক-কর্মকর্তারা এক দল ‘অপ্রস্তুত’ ক্রীড়াবিদদের নিয়ে কিভাবে প্রতি চার বছর পরপর হাসিমুখে প্লেনে চাপেন তা বোধগম্য নয়।
এবার মাত্র সাতজন ক্রীড়াবিদ অলিম্পিকে অংশ নিলেও গলফার সিদ্দিকুরকে কেন্দ্র করে আমাদের কোটি জনতা আশায় বুক বেঁধেছে। আশা করি, ১৪ আগস্ট তিনি আমাদের আনন্দের সাগরে ভাসাবেন। সুরিনাম নামে দেশটিকে যেমন তাদের এক সাঁতারুর সোনা জয়ের কারণে প্রথম ভালোভাবে চিনেছিলাম, তেমনি অচেনা গলফের সাফল্যে আমরাও বিশ্ব মানচিত্রে নতুনভাবে পরিচিতি লাভের সুযোগ পাব। কে জানে? হয়তো আবেগের অতিশায্যে গ্রামগঞ্জে গলফ খেলা ছড়িয়ে দেবার দাবিও তুলতে পারেন কেউ কেউ। এদেশে সবই সম্ভব।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন