রবীন্দ্রনাথ : পাকে বিপাকে দুর্বিপাকে সম্ভাবনা ও আশ্রয়ের
অজয় দাশগুপ্ত
বাইশে শ্রাবণ বাঙালির পরিচয়সূত্র রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিন। এ এক আশ্চর্য মানুষ। কোন ভাগ্যবলে এ বঙ্গদেশে জন্মেছিলেন। জীবনের শুরুতে যেমন জীবন সায়াহ্নেও তাকে দরকার হয় আমাদের। না ভারী কোনো কথা বলব না আজ। বলব এই কবিও কতটা বিপদে আছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে।
এক. এ বছরের শুরুতে কলকাতা গিয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। তীর্থ দর্শনের পবিত্রতা মনে নিয়ে গিয়েও হোঁচট খেয়েছি অনেকবার। ট্যাক্সি ড্রাইভার কতজনকে যে শুধালো, অধিকাংশই মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিয়ে চলে গেলেন। ঠাকুর বাড়ির কাছে গলির মুখের দোকানের পানওয়ালা অনেকটা মুখ ঝামটা মেরে বলেছিল, সামনে যাও বাবু। উধার আছে আপলোগকা ঠাকুর মাকুরকা মোকাম। বুঝুন একবার। ঠাকুর মাকুর তাও মোকাম। হিন্দি আক্রমণের মুখে নিতান্ত অসহায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা গল্প শুনুন তবে;
রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক এক আয়োজনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন মাড়োয়ারী এক ব্যবসায়ী। অনুষ্ঠানে গান নাচ ঝলমলে পরিবেশনার পর তার ভাষণ দেবার পালা। গুরুগম্ভীর পানে মুখভর্তি বিশাল বপুর অতিথি মহাশয় বললেন, রবিন ঠাকুর বহুত বড় ঠাকুর আছিল। উনি বিলায়েত গেল তো একটা নোবেল পুরস্কার লইয়া আসিল। সেই পুরস্কারের টাকায় কী করিল? শান্তি নিকেতন বানাইল। এইখানে কি হয়? দেখেন লেড়কালোগ আপনাকে গানা শুনাইল আর লেড়কী লোগ নাচা দেখাইল। আগার আপনি সজ্জন ব্যক্তি হইবেন তো এবার কিছু টাকা দান করিবেন। বুঝিয়া লন রবিন ঠাকুর কতবড় ব্যবসায়ী আছিল।
দুই. আজকালের বাঙালিও কম যায় না। আঁতেল টাইপের সবজান্তা এক লোক নাকি টকশোতে বলছিল, জীবনে চম্পা কলা, সাগর কলা, সবরি কলা এমনকি কাঁচকলা দেখেছি, খেয়েছিও কিন্তু রবীন্দ্রকলা কী জিনিস? তাতো দেখলাম না। এসব আজগুবী বিষয়ই রবীন্দ্রনাথকে ছোট করে ফেলছে।
তিন. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঘরে খান সেনা ঢুকে দেখে দেয়ালে ঝোলানো দুটো ছবি। একটিতে ক্লিন সেইভড ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো নজরুল। আর একটি গৈরিক আলখেল্লা পরিহিত দাড়ি গোঁফের দরবেশ প্রকৃতির রবীন্দ্রনাথ। নজরুলের ছবিটি বেয়নটের খোঁচায় মাটিতে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথক রাখার নির্দেশ দিয়েছিল তারা। বলেছিল, ইয়ে বুজুর্গকো রাখনা চাহিয়ে। হায় রবীন্দ্রনাথ হায় তার বেশভুষো।
অথচ আমরা অনেকেই জানি না কেন তিনি এই গৈরিক পোশাক ধারণ করেছিলেন। শ্রুত যে রবীন্দ্রনাথ চাইতেন, কেউ জানে তাকে আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট না ভাবে।
সর্বভারতীয় হবার আশায় তিনি এমন এক পোশাক পরিধান করতেন যা উপমহাদেশের সবার সঙ্গে কিছু না কিছু মেলে আবার একেবারে কোথাও মিলবে না। সুফি সন্তদের মতো রবীন্দ্রনাথকে এ নিয়েও কম বিপাকে পড়তে হয়নি।
চার. অতি আধুনিক বা জীবনমুখীদের যন্ত্রণাও কম না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, তার অন্য যেকোনো সৃজনকর্মের চাইতেও গান হবে কালজয়ী। এমনও বলেছিলেন, আর যদি কিছু নাও টেকে গান টিকে যাবে। টিকেছে। আজকের প্রজন্মে তার গান দারুণ ও ব্যাপক জনপ্রিয়। ভাবনা কাহারে বলে, দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি, আমার পরাণ যাহা চায় বা তোমার খোলা হাওয়ার রিংটোনে তরুণ তরুণীরা মাতোয়ারা। কিন্তু দেখুন জীবনবাদী নামে পরিচিত আমার প্রিয় গায়ক নচিকেতার কা-। পাগলা হাওয়ার বাদল দিনের মাঝে মাঝে হু লালা হু লালা বলে কি এক অশ্লীল মাতমের ধ্বনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কপিরাইটের সময় পার হবে যাবার আগে দেবব্রত বিশ্বাসের মতো নিবেদিত গায়ক বাদ পড়লেন ব্যক্তির রোষানলে আর এখন গানে ঢুকছে হিন্দি বা বাংলা শব্দের অশ্লীল ও উচ্চকিত যন্ত্রণা।
যে যাই করুক যাই বলুক রবীন্দ্রনাথ আছেন। আমাদের দেশে তার প্রয়োজন এখনও অধিক। দেশের মাটিতে মাথা ঠেকালে যাদের আঁতে লাগে যারা দিনফুরালে, সন্ধ্যা হলে কি দীপ জ্বালিস ঘরে শুনলে অস্বস্তিতে ভোগেন, যাদের ঘরে আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে ঢুকতে পারে না সেসব বাঙালিরাই আজ হননে মত্ত। এমন আত্মহননের কালে তিনি অনিবার্য। জানি তিনিও বিপন্ন আজ। এ বঙ্গে, ওই বঙ্গে কোথাও তার জায়গা আগের মতো নির্মল নেই। কিন্তু তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন বাঙালি হয়ে বিশ্বমানব হতে। তার হাত ধরে আমরা অনায়াসে জীবন পাড়ি দিতে পারি। রাত্রি এসে যেথায় মিশে দিনের পারাবারে তোমায় আমায় দেখা হবে সি মোহনার ধারে
এমন বাঙালি আর কে আছেন? যার কথায় আমরা দেশের অকল্যাণে অসুন্দরে বলতে পারি। তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।
লেখক : সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন