আজ ৭৫তম প্রয়াণ দিবস সাম্প্রদায়িকতার সংকটে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আলোকবর্তিকার মতো
রিমন মাহফুজ : আজ বাইশে শ্রাবণ। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস।
আজ থেকে ৭৫ বছর আগে বাংলা ১৩৪৮ সনের এই দিনে (৬ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে শ্রাবণের বর্ষণসিক্ত পরিবেশে তিনি ৮০ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। আজ শনিবার বাংলা একাডেমি, ছায়ানটসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে কবিগুরুকে স্মরণ করবে। এসব অনুষ্ঠানে গাওয়া হবে তারই লেখা গান, আবৃত্তি করবে তারই কবিতা, মঞ্চায়িত হবে রবীন্দ্র নাটক।
১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করেন। তার জীবনের শেষ চারটি বছর কেটেছে শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে। ১৯৩৭ সালে একবার অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন, তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। এ সময় তিনি মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজন করেন বেশ কিছু অবিস্মরণীয় পক্সিক্তমালা। যদিও প্রথম জীবনে তিনি ভানুসিংহের পদাবলিতে লিখেছিলেন, ‘মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান … মৃত্যু অমৃত করে দান।’
জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি লেখেন- বিখ্যাত সেই পক্সিক্ত ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
প্রয়াণের ৭৫ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ অনির্বাণ শিখার মতোই জ্বলছেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। বাঙালি প্রতিদিনই তাকে স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে। আজও পথ খুঁজতে হয় তারই স্ফুলিঙ্গ ধরে। বাঙালির সব উৎসবেই আছেন রবীন্দ্রনাথ। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা ছিল তার রচনা। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ তার রচিত।
বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষে আজ বিভিন্ন সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়াও বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে।
এ উপলক্ষে ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনা’ নিয়ে গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশ-বিদেশের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরাও বললেন, বিশ্বজুড়েই অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সংকটে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বকবির ভাবনা অপরিহার্য হাতিয়ার ও আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে।
এ উপলক্ষে উত্তরাক্লাবে দুদিনের সম্মেলনের উদ্বোধনের সময় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতার বলি হয়ে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ যখন বিপদগামী হয়ে উঠছে, তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, কবিতা ও শিক্ষাভাবনার চর্চা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।’
বাংলাদেশ-ভারত-জাপান-চীনের রবীন্দ্র গবেষক, রবীন্দ্রবিষয়ক শিক্ষার্থীদের নিয়ে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে এই সম্মেলন হচ্ছে।
স্বাগত বক্তব্যে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের অধিকর্তা মুনমুন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার এমন অনেক দিক রয়েছে, যা চর্চার অপেক্ষা রয়েছে। সেগুলো নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা নেওয়া প্রয়োজন।’
সময়ের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা অগ্রসর ছিল উল্লেখ করে বিশেষ অতিথি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে ব্যক্তির, ভাবনার সঙ্গে কর্মের, জ্ঞানের সঙ্গে মনুষ্যত্ববোধের, স্থানিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার, আহরণের সঙ্গে প্রকাশনের, আনন্দের সঙ্গে শিক্ষালাভের যে চিন্তা তিনি করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক।’
উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াসমীন আরা লেখা বলেন, ‘শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের এই মিলনমেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ও শিক্ষা ভাবনার বহুমাত্রিক দিক উঠে আসবে, যা বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থার অবক্ষয় রোধ ও টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম আবু দায়েন বলেন, ‘উন্নয়ন, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতির কূটচালে পিছিয়ে পড়া জনপদের এক প্রাদেশিক ভাষায় সাহিত্য রচনা করে একজন মানুষ স্থান-কাল নির্বিশেষে এমন অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারেন, সেই গর্ব রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়ে গেছেন।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিরোনামের বিষয়ে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন একুশে পদকজয়ী সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ হায়াৎ মামুদ।
আলোচনায় অংশ নেন চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চেন শিনে ও জাপানের হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাছাহিকো টোগাওয়া।
আগামীকাল দ্বিতীয় দিন ‘রবীন্দ্র চিন্তায় প্রাথমিক শিক্ষা’, ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রেক্ষাপট ও গতিপ্রকৃতি’, ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-আদর্শ ও বাঙালি মধ্যবিত্ত’, ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা’, ‘রবীন্দ্র শিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণ’. ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শে শিক্ষার্থী মনস্তত্ত্ব’, ‘মানবাধিকার শিক্ষা ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘আমাদের সামগ্রিক জীবনে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রভাব: শিক্ষা-ভাবনা’, ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার স্বাতন্ত্র্য: মুক্তির আনন্দ’, ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনা ও একটি প্রস্তাবনা’, ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম: পতিসরপর্ব’, ‘ভাষা শিক্ষা ও রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘শিক্ষার মিলন: একটি রবীন্দ্র বিবেচনা’ বিষয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।
এদিন আলোচনায় অংশ নেবেন সংসদ সদস্য সাহারা খাতুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ও ইতিহাস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।
আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এ এস এম আবু দায়েন জানান, সেমিনারগুলোতে রবীন্দ্র সাহিত্যে শিক্ষা ও সমাজ জীবনের বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি নান্দনিকতার দিকটিও আলোচিত হবে।
সম্পাদনা: এএইচসি