সরকারের পদক্ষেপ কূটনীতিকরা আস্থায় নিতে পারছেন না
দীপক চৌধুরী : গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে সশস্ত্র জঙ্গি হামলার পর নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কূটনীতিকদের মধ্যকার আলাপ আলোচনায় নিজেদের অস্থিরতা ও উদ্বেগের বিষয়টি সরকারও চিন্তিত। বিদেশিদের আস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের সবরকম চেষ্টার পরও দোদুল্যমান কূটনীতিবিদরা। এসব কারণে তারা সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা চান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত একটি টাস্কফোর্স ঢাকায় দায়িত্বরত কূটনীতিক ও মিশনগুলোর কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘নতুন কিছু পদক্ষেপ’ নেওয়ার সুপারিশ করেছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে এ টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। কিন্তু টাস্কফোর্সের কার্যক্রমের ওপর তারা শতভাগ নিশ্চিত হতে পারছেন না। গুলশানের নজিরবিহীন জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলায় ইতালি ও জাপানের ১৫ নাগরিকসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করার ঘটনা তারই ইঙ্গিতবহ বলেই জানেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিদেশি কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলায় বিদেশিরা টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। প্রায় একবছর ধরে বাংলাদেশ সরকারকে তারা নিরাপত্তা বিষয়ে তাগিদ গিয়ে আসছেন। এসব হামলায় বিদেশিরা টার্গেট হতে পারেন বলেও বিভিন্ন দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এখন তারা আশঙ্কা করছেন আরও হামলা হতে পারে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। বিদেশি কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর এখন ‘নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা’ রয়েছে তা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। ফলে কূটনীতিকরা গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানান।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার পর বিভিন্ন দূতাবাসের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ কোনো কোনো দূতাবাস ও হাইকমিশন তাদের বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অনুমতি চেয়েছে। ইতালি ও জাপানসহ কিছু দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে তাদের কূটনীতিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্প ও নানা ক্ষেত্রে কর্মরত নাগরিকদের বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে। এ বিষয়ে এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। জাপানের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (জাইকা) প্রেসিডেন্ট শিনিছি কিতাওকার ঢাকা সফর স্থগিত হওয়ার নেপথ্যে নিরাপত্তাজনিত কারণ ছাড়াও রয়েছে দুর্বল কূটনৈতিক তৎপরতা। দুই দিনের সফরে ৬ আগস্ট তার ঢাকায় আসার কথাছিল। তবে তিনি আসবেন না বলে জানিয়েছে জাপান দূতাবাস।
উল্লেখ্য, গুলশানে হামলায় নিহত জাপানের সাতজন নাগরিকের ছয়জন কাজ করতেন সে দেশের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে পরিচালিত ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পে।
একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ঢাকার জাপান দূতাবাস গত ১৪ জুলাই চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ‘বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের অস্ত্র বহনের অনুমতি’ চেয়েছিল। কিন্তু ‘বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের অস্ত্র বহনের অনুমতি’ দিতে আগ্রহী নয় বাংলাদেশ। এটা সম্ভবও নয় বলে জানা গেছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএইড) কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান নিজের বাসায় নির্মমভাবে খুন হওয়ার পর মার্কিন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা জোরদারের একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের অস্ত্র বহনের অনুরোধ জানিয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বেসরকারি ওই সংস্থাটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওই অনুরোধে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ। এ বিষয়ে একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জানান, কোনো দেশের হাইকমিশন ও দূতাবাসের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অস্ত্র বহনের অনুমতি দেওয়ার কোনো বিধান নেই।
যদিও জাপানের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (জাইকা) ঢাকা কার্যালয় এবং সারাদেশের প্রকল্পগুলোতে জরুরিভিত্তিতে সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশি পাহারা দিচ্ছে। জাইকার পাশাপাশি জাপানের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাহায্য সংস্থায় কর্মরত সে দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা জোরদারে সরকারকে বাড়তি পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার টাস্কফোর্সে বৈঠকের পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন। ইইউ রাষ্ট্রদূতকে টাস্কফোর্সের বৈঠকের ফলাফল অবহিত করা হয়। এ সময় বিদেশিদের নিরাপত্তা নিয়ে ইইউর উদ্বেগ ও বাংলাদেশে আরও সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কার কথা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে উঠে আসে। তিনি একদিন আগে বিবিসির কাছে নিরাপত্তা বিষয়ে এ শঙ্কা ব্যক্ত করেন।
নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্বেগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, হলি আর্টিজানের ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেনÑ এমন কথা ঠিক নয়। এ ঘটনার পর বরং দেশে জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিভিন্ন জায়গায় বলা হচ্ছে, গুলশানে ক্রেতা নেই, হাহাকার চলছে। আসলে ঈদের পর অনেক ব্যবসায়ী ১৫ থেকে ২০ দিন দোকানপাট বন্ধই রাখেন। তারা গ্রামের বাড়ি যান। এছাড়া জুলাই-আগস্ট মাস বিদেশে অবকাশযাপনের সময়। এ সময়ে বিদেশিরা কমই আসেন। তাই বিদেশি ক্রেতা কম হতে পারে। সবাই চলে যাচ্ছেন বলে যে বক্তব্য দিয়ে লেখালেখি চলছে, তা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তোফায়েল আহমেদ। সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতাকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ মনে করছেন বলে আবারও জানান তিনি। বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। বিদেশে ক্রেতারা ভারতে চলে যাচ্ছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর দেখেছেন জানিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ বলেন, আসলে তা হচ্ছে না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আলিসন ব্ল্যাক বলেছেন, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে এলেও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়েগের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। বাণিজ্য ও উন্নয়নে যুক্তরাজ্যের প্রদত্ত সাহায্য ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। সম্পাদনা : এএইচসি