আছে-নাই’র অন্যদিনের বন্ধুদিন
আমি বসে আছি পাঁচিলের ওপর, পাঁচিলের উচ্চতা বেশি না, দু-আড়াই ফুটের মতন হবে। বসে বসে ডানে বামে পা দুলাচ্ছি। পায়ের দুলুনিতে আমার নীল রঙের বা পায়ের চপ্পলটা ছিটকে ঘাসের ওপর যেয়ে পড়ল। গাঢ় সবুজের মাঝে ক্যাটক্যাটে নীলের কম্বিনেশন দেখতে কি যে সুন্দর লাগছে। কষ্ট করে উঠে যেয়ে চপ্পলটা তুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আপাতত। পা দুলুনিতে কেমন মাদকতা আছে। তাই উপভোগ করছি। আর সঙ্গে উপভোগ করছি ‘নাই’ সাহেবের হাবভাব। নাই সাহেবের কনফিউসড ভাব সঙ্গে হালকা হিংসা মেশানো চেহারাটা এই মুহূর্তে আমার কাছে ভীষণ উপভোগ্য। আমার মতন করে তারও পাঁচিলে বসতে ইচ্ছে হচ্ছে বলে আমার ধারণা। কিন্তু এক লাফে সে পাঁচিলে উঠে বসতে পারবে না। ইট জাতীয় কোনো প্লাটফর্ম পেলে তার সাহায্যে পাঁচিলে বসতে পারত। সে এখন আশেপাশে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে, ইট বোধ হয়।
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘বলতো আজকে কি দিন?’
‘নাই’ কোনো উত্তর দেয় না। ইট খোঁজা বাদ দিয়ে সে এখন তার বালুর পা চুলকাচ্ছে।
আবার জিজ্ঞেস করি, ‘কি জানিস না?’ মাথা নাড়ে, সে জানে না। বলি, ‘আজ বন্ধু দিবস’। ‘নাই’ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, পা চুলকানো থামিয়ে, মাথা উঁচু করে আমার কথা শোনে। ‘ওই দেখ সামনে দেখ, এরা হলো সবাই বন্ধু।’ ‘আপনারে কে বলল?’ নাই পাল্টা প্রশ্ন করে। না মানে আমাকে কে বলবে? আমি জানি তো, আজ বন্ধু দিবস, আজ বন্ধুরা ঘুরবে।
নাই আজকে জামার সুতা টানছে না। সে পরে আছে ডিমের কুসুম রঙের মলিন এক ফতুয়া। আজ তার হাতেই একটা কমলা সুতার টুকরা। সেই সুতা আঙুলে আংটির মতন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খেলছে সে এখন।
বলি, ‘বলতো বন্ধু দিবসে মানুষ কি করে?’ ‘ফুচকা খায়’, সামনের দিকে মানুষজন দেখতে দেখতে বলে। ‘কে বলল তোকে?’ ‘ওই যে।’ সামনের দিকে আঙুল তুলে দেখায়। ‘তো অন্যদিন বুঝি মানুষ ফুচকা খায় না?’ নাই সুতার টুকরা এখন গলায় পেঁচিয়ে নতুন খেলা খেলছে। উত্তর দেয় না।
আমি বলি, ‘বন্ধু দিবসে মানুষ বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায়।’ ‘ওহ, আর অন্যদিনে কি করে?’ আমি এবার কোনো উত্তর দেই না। উত্তর জানি না। মনে হচ্ছে আমিও একটা সুতা পেলে ভালো হতো। সুতা নিয়ে ব্যস্ত থাকা যেত। চুপ করে বসে থাকি। সামনের ফুচকার গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলি, ‘ফুচকা খাবি?’ ‘নাহ ঝাল’। ‘হুম, তোর বন্ধু আছে?’ পাশে তাকিয়ে দেখি ‘নাই’ কোন ফাঁকে কায়দা করে পাঁচিলে উঠে বসেছে। ‘মকবুল চাচা’, উত্তর দেয় সে ‘মকবুল চাচা তোর বন্ধু?’ ‘হু, সে আমাকে ভালো পায়।’
‘ওহ ভালো পেলেই বন্ধু হয়? ভালো তো, তুই তো মহাজ্ঞানী রে।’ ‘নাই’ মনে হয় উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
‘আমি কি তোর বন্ধু?’ প্রশ্ন করি, ‘নাই’ কোনো উত্তর দেয় না। কিন্তু ‘নাই’ আমার মতন করে ডানে-বামে পা দুলায়। আমি এক পায়ে চপ্পল পরে পা ডানে-বামে দুলাতে থাকি, ‘নাই’ বালুর পা দুটো ডানে-বামে নাচাতে থাকে, আমার মতন করে। ‘আছি’ এবং ‘নাই’ মিলে একসঙ্গে পা নাচাতে থাকি। সে দুলুনিতে ‘নাই’ এর পায়ের বালুর ছিটা আমার পায়ে এসে পড়ে। আমার পাও কেমন বালুর পা হয়ে ওঠে।
ফুচকা অনেক ঝাল বলে আমরা খাই না। কিন্তু পা নাচাতে নাচাতে আমরা সামনে তাকিয়ে তাদের ফুচকা খাওয়া দেখতে থাকি, যাদের আজকে বন্ধুদিন আর অন্যদিন বন্ধুহীন কিংবা অন্যদিনও অন্যরকম বন্ধুদিন।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন