ঘৃণায় ঘৃণা বাড়ায়
মাসুদা ভাট্টি
হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীÑ একটি বিখ্যাত লাইন, বাঙালি মাত্রেরই জানার কথা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই মুহূর্তে যে পৃথিবীতে আমাদের বসবাস তার ক্ষেত্রে এই কথাটি সর্বৈব সত্য। আজ সকালেই পাঠ করা একটি সংবাদের কথা বলি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি এয়ারলাইন এক মুসলিম দম্পতিকে তাদের বিমানে উঠতে দেয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বেরুচ্ছিল এবং তারা মুখে ‘আল্লাহ্’ শব্দটি উচ্চারণ করছিলেন (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা)। যারে দেখতে নারি তার চরণ বাঁকাÑ এই প্রবাদও আমাদের জানা। এক্ষেত্রে কথাটি কেন বললাম? বলেছি, কারণ, যেহেতু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতি দুনিয়াজুড়ে ঘৃণা বাড়ছে সেহেতু মুখে আল্লাহ্্র নাম থাকা কিংবা শরীরে ঘামের গন্ধ থাকাটা একটা বিশাল অপরাধ এবং সে কারণে আমি ন্যায্য দামে টিকিট কিনেও বিমানে চড়তে পারব না, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা কি আর হতে পারে?
ফ্রান্সের একটি হালাল ফ্রায়েড চিকেন শপের মালিককে একদল দুর্বৃত্ত হুমকি দিয়েছে যে, যদি তারা তাদের দোকানে অ্যালকোহল ও শুকরের মাংস বিক্রি না করে তাহলে দোকানটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। এখন চলুন বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করি। ফ্রান্স গত কয়েক বছর ধরে যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সে দেশের মুসলিম অভিবাসী সম্প্রদায়কে নিয়ে, তাতে আগামী কয়েক দশকেও কি সে দেশের মূল ধারা থেকে মুসলিম-বিদ্বেষ ধুয়ে ফেলা সম্ভব হবে? অনেকেই বলতে পারেন যে, কেন ওরা ইসলামকে নিয়ে ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ করেনি? তার বেলা? আসুন আরও একটু গভীরে ভাবি। শার্লি এবদো একটি কার্টুন পত্রিকা, তারা যে কোনো কিছু নিয়েই ব্যঙ্গ করতে পারে। পৃথিবীজুড়ে ইসলামে বিশ্বাসীদের একাংশ যে ভয়াবহ তা-বের সৃষ্টি করেছে তাতে তাদেরকে নিয়ে কেবল ফ্রান্স কেন, অনেক দেশেই তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। এছাড়াও শার্লি এবদো তো কেবল ইসলামকে নিয়েই ব্যঙ্গ করছে না, দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মকে নিয়েও তারা ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন ও লেখা প্রকাশ করেছে। কই হিন্দু, খ্রিস্টান কিংবা ইহুদিরা তো কেউ শার্লি এবদো পত্রিকা আক্রমণ করতে যায়নি? হ্যাঁ, আমরা বিতর্ক করতে পারি যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আসলে কতটুকু অবধি চর্চা সম্ভব এবং ফ্রান্স বা ইউরোপে এ ধরনের বিতর্ক মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের মুখ থেকেই শোনা গেছে। এমনকি ফ্রান্সের মূলধারার গণমাধ্যমে শার্লি এবদো’র ভূমিকা নিয়ে রয়েছে বিবিধ প্রশ্ন, এমনকি বিষয়টি আদালতেও নেওয়া যেত বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কিন্তু সেটা তো হয়নি, শার্লি এবদো আক্রান্ত হয়েছে, রক্তপাত দেখেছে ফ্রান্স এবং এই রক্তপাতের জন্য আর কেউ নয়, দোষ পুরোটাই এসেছে ফ্রান্সের অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘাড়ে। গত কয়েকদিনে ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় যেসব জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে সেগুলো নিয়ে একটু ভেবে দেখুন, দেখবেন যে, কোনোভাবেই এর দায় মুসলিম সম্প্রদায় এড়াতে পারবে না। হ্যাঁ, আমরা কথায় কথায় বলে থাকি যে, মধ্যপ্রাচ্যের ওপর একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। তেলের লোভে মধ্যপ্রাচ্যকে কন্ট্রোলে রাখার জন্য একটা ধর্মযুদ্ধই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সর্বত্র। কথাটি একটুও মিথ্যে নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের দিকে একবার তাকান। একটি জনগণের রাষ্ট্র দেখিয়ে বলুন যে, সেখানে জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। না নেই। সেখানে একদল সুবিধাবাদী মানুষ খান্দানের পর খান্দান দেশগুলো শাসন করে এবং তাদের সুবিধানুযায়ী পশ্চিমে তাদের মিত্র তৈরি হয় কিংবা মিত্রতা ভাঙে। পশ্চিমও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বেনিয়া-রাজনীতি করে চলেছে যুগের পর যুগ ধরে এবং মধ্যপ্রাচ্যকে মনে করছে তাদের খেলার মাঠ, আর সে মাঠে ধর্ম হলো তাদের প্রিয় ফুটবলটি। মেসি কিংবা রোনালদোর চেয়েও দুর্দান্ত কৌশলী পাস দেয় যখন-তখন এই ধর্ম দিয়েই। ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হলো, এভাবে ধূর্ত পশ্চিমের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা কিংবা বিচ্ছিন্ন আক্রমণ ঘটিয়ে কি ধর্মের কোনো উপকার হবে? নাকি অতীতে হয়েছে? দেখতে দেখতে কিন্তু আমরা প্রায় দুটি দশক পার করে ফেলছি এই ধর্মাশ্রয়ী বিস্ফোরণের (৯/১১-এর ঘটনা স্মর্তব্য) এবং তারপর দেশে দেশে আক্রমণ কিন্তু কম হয়নি, কিন্তু পশ্চিম কি সরে এসেছে তাদের বেনিয়া রাজনীতি থেকে? সরেনি। তাহলে কেন এই প্রাণক্ষয়? কেন কতিপয় মুসলমানের জন্য বাকি সমস্ত মুসলমানকে তার দায় বহন করতে হবে?
পশ্চিম বা মধ্যপ্রাচ্যকে বাদ দিই। পাকিস্তানের দিকে তাকাই। ভারত ও পাকিস্তান একদিনে যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু আজকে দুটি দেশের চেহারা, অবস্থান, সম্মান ও বৈশ্বিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ দু’রকম। কেন? যারা পাকিস্তানের আজকের দুরবস্থার কারণ হিসেবে ধর্মকে দেখতে পান না, তাদের আমার বলতেই হবে যে, তারা আসলে হয় বোকা, নয় ধূর্ত বা মিথ্যেবাদী। পাকিস্তান প্রথমে তার দেশের সংখ্যালঘুকে অস্বীকার করেছে, তারপর এখন নিজেরা নিজেরা লড়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেশটির নিয়তি মাত্র এবং তা অতি দ্রুতই হবে। এবার তাকান বাংলাদেশের দিকে। এদেশেও কি ধর্মকে আশ্রয় করে ক্ষমতা লাভের লড়াই শুরু হয়নি? টের পান কি সেটা? পাওয়ার কথা। দেখুন তো একবার দৃষ্টি প্রসারিত করে, আপনার প্রতিবেশী হিন্দু ধর্মের কজনকে এখন দেখতে পান? একটু বয়েসী যারা এই কলামটি পড়ছেন, তারা একবার আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো, যারা চলে গেছে তারা কী পরিমাণ দুঃখ-কষ্ট-নির্যাতন-গঞ্জনা নিয়ে এদেশ ছেড়েছেন? আপনি কি ভেবেছেন, ওরা গেছে, এইবার আপনি নিরাপদ? দুঃখিত জনাব, সে গুড়ে বালি। এরপর আপনার পালা। কিন্তু আপনি পালাবেন কোথায়? হোলি আর্টিজান কিংবা শোলাকিয়ার ময়দানে আপনি-আমি-আমরা যে কেউ থাকতে পারতাম, কোথায় পালাতাম বলুন তো? না, পালানোর জায়গা নেই। বিদেশে যাবেন? সেখানেও আপনাকে বিমানে বসতে দেবে না, আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হুমকি হবে, আপনার নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। কারণ আপনি বা আপনারই মতো কেউ তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল, তার শোধ ওরা আপনার ওপর তুলবে। আর এদেশে? এদেশে হয় আপনাকে ওই ধর্মবাজদের কথায় আপনাকে নাচতে হবে, না হলে আপনাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে, যেমনটি হচ্ছে পাকিস্তানে।
তাই, একবার ভাবুন, আপনি কী চান? একটা সুখী, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ নাকি ভঙ্গুর, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা পাকিস্তান? নাকি চান বিশ্বময় আপনার জন্য সুরক্ষিত হোক চরম ঘৃণা। ঘৃণায় ঘৃণা বাড়ায়, প্রেম মারে সংঘাত … একবার ভেবে দেখুন, দেখবেন, এই কথাটি আপনার পরিবারে যেমন সত্য, তেমনই সত্য সমাজে, রাষ্ট্রে এবং এই পৃথিবীতে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সধংঁফধ.নযধঃঃর@মসধরষ.পড়স
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন