জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানা শিবিরের মেস
ইসমাঈল হুসাইন ইমু : নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, হুজি ও আনসারউল্লাহ বাংলা টিম এখন একজোট। সারাদেশে হত্যা ও নাশকতা চালাচ্ছে তারাই। এদের পেছন থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করছে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। এভাবে শিবিরের আস্তানাগুলোতে তৈরি হচ্ছে বোমা আর পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও বৈঠকের কার্যক্রম চলছে নাশকতা চালানোর।
সম্প্রতি গোয়েন্দার সংস্থার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে শিবিরের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শিবিরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় দেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা সংগঠিত হচ্ছে। শিবিরের আস্তানাগুলোতে জঙ্গিরা আশ্রয় নিচ্ছে। শিবির নিয়ন্ত্রিত কোচিং সেন্টার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জঙ্গিরা নিয়মিত বৈঠক করছে এবং প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। গুলশানে জঙ্গি হামলার পর জঙ্গিদের নেপথ্য মদতদাতাদের সন্ধানে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নামে। এরপর বেরিয়ে আসে এসব খবর। জানা যায়, জঙ্গিদের শেল্টারহোম হচ্ছে রাজধানীতে শিবিরের মেস, ভাড়া করা ফ্ল্যাট ও কোচিং সেন্টারগুলো। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে আসা জঙ্গি সদস্যরা এসব স্থানে মিলিত হয়। আবার রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলা শহরের শিবিরের আস্তানাগুলোতেও জঙ্গিরা আশ্রয় নিচ্ছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, পাবনা, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, গাজীপুর জেলাগুলোতে এ ধরনের কার্যক্রম বেশি চলছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর উত্তরা থেকে র্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত জেএমবি সদস্য কামরুজ্জমান ওরফে সাগর ও রাশেদ গাজী ওরফে রাশেদ গ্রেফতার হয়। তারা ঢাকায় আসার আগে যশোরের পাঠশালা কোচিং সেন্টারে যায়। এই কোচিং সেন্টারটি শিবিরের নিয়ন্ত্রণাধীন। শিবিরের নেতাকর্মীরাই এই কোচিং সেন্টারটি পরিচালনা করতো। এই কোচিং সেন্টারের অধীনে একটি মেস আছে। যশোরে থাকা অবস্থায় তারা এই মেসে অবস্থান করতো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক জঙ্গি সদস্য সেখানে আসতো। পাঠশালা কোচিং সেন্টারে বসে প্রশিক্ষণের উপযোগী জঙ্গি সদস্য নির্বাচন করে প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রামে পাঠানো হতো। বৈঠক করা হতো সাংগঠনিক পরিকল্পনা নিয়ে। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীসহ বাইরের লোকজন ভাবতো যে, ছাত্ররা কোচিং করছে। কিন্তু বাস্তবে সেখানে জঙ্গি কার্যক্রম চলতো। র্যাবের গোয়েন্দারা ওই মেসে নজরদারি শুরু করে। গত ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গি হামলার পর যশোরের ওই মেস থেকে বেশ কয়েকজন জঙ্গি চলে যায়। র্যাব এদের অনুসরণ করে পরবর্তীতে টঙ্গী কলেজ গেট এলাকার আস্তানার সন্ধান পায়। এভাবে দেশের বিভিন্ন শহরে জঙ্গিরা শিবিরের ছত্রছায়ায় জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে। রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর, ১০ নম্বর, পল্লবী এলাকার কয়েকটি স্থানে শারীরিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিছুদিন আগেও মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের সনি সিনেমা হলের পাশে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। একসঙ্গে বাছাইকৃত ৮ থেকে ১০ জন জঙ্গি সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দেড় মাস থেকে ২ মাস এই প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশনাল কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রশিক্ষণে যারা ভালো করে তাদেরই আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট, পল্লবী, মোহাম্মদপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, রামপুরা, কমলাপুর, আরামবাগ, সবুজবাগ, মালিবাগ, খিলক্ষেত, আজিমপুর, কলাবাগান এলাকায় শিবিরের মেসের সংখ্যা বেশি। ফার্মগেট, খিলগাঁও, মালিবাগ, মিরপুর, গ্রীনরোড এলাকায় শিবিরের কোচিং সেন্টারের সংখ্যা বেশি বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে রাজধানীতে শিবিরের প্রায় ১৪/১৫টি আস্তানায় জেএমবি ও আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের সদস্যরা বোমা তৈরি করতো। বোমা তৈরির পর তা শিবিরের মেসে নিয়ে মজুদ করা হতো। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের লাগাতার অভিযানের পর আজিমপুর, ডেমরা ও কলাবাগান থানা এলাকায় শিবিরের মেসে অভিযান চালিয়ে বিপুলসংখ্যক বোমা উদ্ধার করা হয়। এরপর শিবিরের আস্তানার সংখ্যা কমে যায়। তবে চলতি বছরের প্রথম দিক থেকে আবার তা বৃদ্ধি পায়। শিবিরের বোমা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেএমবি ও আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের সদস্যরা বোমা তৈরির শিক্ষা নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব হাতবোমা উদ্ধার করা হয়েছে তা খুবই শক্তিশালী ও দক্ষ হাতের তৈরি। শিবিরের বোমা বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় এসব বোমা তৈরি করা হয়েছে বলেও গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য মিলেছে। বোমা তৈরিতে যাদের দক্ষ প্রশিক্ষণ রয়েছে তারাই এত নিখুঁতভাবে এই বোমা তৈরি করতে পারে। বোমা তৈরির কাঁচামাল শিবিরের লোকজনই সরবরাহ করে। শিবিরের একাধিক গ্রুপ রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার থেকে বোমা তৈরির এসব কাঁচামাল দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে অনেক আগেই হুজি ও জেএমবির ক্যাডারদের যোগাযোগ রয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তার কারণে এক বছর আগে মেস ছেড়ে অনেক শিবির ক্যাডার ফ্লাট ভাড়া নেয়। কিন্তু এখন ভাড়াটিয়ার তথ্য চাওয়ার পর আবার তারা মেসে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে।
সম্পাদনা : আ. হাকিম