রাজনীতিতে নারী ও মার্কিন সমাজ, দুই প্রথমার গল্প
লিহান লিমা : নারী রাজনীতির কথা ভাবলে আমাদের সামনে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার চিত্র উঠে আসে। যদিও নারীরা ১৮৪০ সাল থেকেই তাদের অধিকারের প্রতি সোচ্চার হয়েছিল। যা আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকারের সূচনা করে। তবে গৃহযুদ্ধের পর এবং আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার অর্জনের অর্ধ-শতাব্দি আগেই বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন এক নারী । বলছি ১৮৭২ সালে তৎকালীন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ‘ইক্যুয়াল রাইটস পার্টি’ থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে মনোনায়নপ্রাপ্ত ‘ভিক্টোরিয়া উডহল’-এর গল্প । শতাব্দি পেরিয়ে ২০১৬ সালে আমেরিকায় নারী ভোটাধিকারের পর প্রথম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে হিলারি ক্লিনটন মনোনয়ন পান। সূত্র : হাফিংটন পোস্ট
চলুন দেখে আসি ১৪৬ বছরের অপরিবর্তনীয় ও পরিবর্তনের দিকগুলো:
১৮৭২ সাল, ব্যবসা এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে নারী কখনই সাহস দেখায়নি:
ভিক্টোরিয়া উডহলের সময় নারীদের ভোট দেওয়া বা অফিসে যাওয়া ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। নারীঅধিকার বিরোধী ‘ক্যাথরিন বিচার’ লিখেন, ‘ বাইবেল নারীকে বহিঃজগত থেকে অন্তরালে থাকার নির্দেশ দিয়েছে, কারণ নারীদের কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে যা তাদের পালন করা দরকার এবং তারা শারীরিক কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুপযোগী।’
আমেরিকার সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে সাহস আর সৌন্দর্যের প্রতীক ভিক্টোরিয়া ও তার বোন টিনি বিশ্বখ্যাত ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের শেয়ারের মালিক হন এবং এটি পরিচালনা করেন। যদিও তখন আমেরিকায় নারীদের শেয়ার বাজারে প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু কৌশলী ভিক্টোরিয়া পুরুষের মাধ্যমে তার ব্যবসার প্রচার করেন এবং মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার আয় করেন।
২০১৬, ব্যবসা এবং রাজনীতে নারীদের অবস্থান স্বাভাবিক হলেও সমতা অর্জন হয়নি; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৪৬.৮ ভাগ এবং ৫১.৫ ভাগ নারী ব্যবস্থাপনা এবং পেশাদার অবস্থানে আছে কিন্তু ৫০০ কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৪ ভাগ নারী কোম্পানির সিইও পদে আছেন এবং সেখানে বোর্ডে নারীদের আসন ১৯.২ ভাগ।
২০১৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসে নারীর সংখ্যা ১০৪ যা ৫৩৫ জন সদস্যের মধ্যে ১৯.৪ ভাগ, এর মধ্যে সিনেটে ২০ ভাগ এবং হাউস অব রিপ্রেজেন্টটেটিভে ৮৪ জন নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিছু আশাবাদী বিশেষজ্ঞ জানান, ‘লিঙ্গ সমতায় পৌঁছতে নারীদের ২১২১ সাল লাগবে এবং ২০৫৮ সালে নারীরা মার্কিন কংগ্রেসে সমতা পাবেন বলে অনুমান করা যাচ্ছে।’
১৮৭২, নারী প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য সমর্থন পায়নি: ৯০-র দশকে নারীর জনসম্মুখে কথা বলা গ্রহণীয় ছিল না। এটিকে লজ্জাহীন বলে বিবেচনা করা হতো। তার পিতা-স্বামীকে অপমান করা হতো।
কিন্তু সুশান বি, এন্থনি এবং এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যাটন নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলে যাচ্ছিলেন। ভিক্টোরিয়া উডহল তাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং অধিকারের কথা ব্যক্ত করেন। তবে এছাড়াও তিনি কথা বলেন শ্রমিকের অধিকার, যৌনকর্মীদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং বিবাহিত নারীদের প্রতি স্বামীর একচ্ছত্র যৌন অধিকারের বিরুদ্ধে। ১৮৭২ সালে তিনি নারী অধিকারের ধারণাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যান। তার বোন টিনি কংগ্রেস থেকে নিউইয়র্কের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়ান। তিনি জয় লাভ না করলেও পরবর্তী হাজার বছরের জন্য এক দেয়াল ভাঙার ইতিহাস লিখে যান।
২০১৬, নারীরা প্রতিষ্ঠান চালালেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন: ২১ শতকে প্রতিটি প্রার্থীই তার অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা এবং অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ভোটার এবং অন্যান্য প্রার্থীর দ্বারা মনোনীত হন। কিন্তু মুছে যায়নি নারীর প্রতি বিরূপ মনোভাব। ডোনাল্ড ট্রাম্প এক মন্তব্যে বলেন, ‘নারীরা যখন দৌড়ায় তখন তাকে ভিন্ন মনে হয়’। ট্রাম্পের চুলের চেয়ে গণমাধ্যম নারী প্রার্থীর চেহারা, চুল এবং পোশাকপরিচ্ছদ নিয়ে বেশি আলোচনা করে। সম্প্রতি তিনজন নারী প্রার্থী দলের মনোনায়নের সাক্ষাৎকারের পর বলেন, তারা লিঙ্গগত বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
১৮৭২, নারীদের ভোটের অধিকার ছিল না: ১৮৪৮ সালে সেনেকা ফলস কনভেনশনে নারী ভোটাধিকারের জন্য প্রচারণা চালানো হয় এবং ১৮৭৮ সালে কংগ্রেসে এর উনবিংশ সংশোধনী গ্রহণ করা হয়। ১৮ আগস্ট, ১৯২০ সালের আগে এটি অনুমোদন করা হয়নি। তারপরও এটি শুধুমাত্র ১২টি রাজ্যে ( আলাস্কা এবং হাওয়াই ছাড়া) গৃহীত হয়। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার কিছু প্রদেশে আফ্রো-আমেরিকান নারীরা ভোট দিতে গিয়ে আক্রমণ এবং অপমানের শিকার হন। ১৯৬৫ সালের ৬ আগস্ট আইনগতভাবে ‘ভোটের অধিকার আইন’ পাস হয় এবং লিঙ্গ, জাতি নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে ভোটের অধিকার প্রদান করা হয়। ৬৪ বছর পর ‘২২ মার্চ ১৯৮৪’ সালে উনবিংশ সংশোধনী চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।
২০১৬, ভোটের অধিকার: ২০১৬ সাল জয়ের, ভোট দানের অধিকার থেকে নেতৃত্ব দানের দিকে এগিয়ে চলার, ২০১২ সালের নির্বাচনে ৫৩ ভাগ ভোটারই ছিলেন নারী।
১৮৭২: নারীর প্রতি গণমাধ্যমের আক্রমণাত্মক মনোভাব এবং তার ব্যক্তিগত জীবনকে তুলে ধরা: সংবাদপত্রগুলো রাজনৈতিক প্রার্থীর প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করতেন কিন্তু ভিক্টোরিয়া এবং টিনির ক্ষেত্রে তাদের পোশাক, জন্ম,পরিবার, বংশ, জনমত এবং যোগ্যতা বিচার করত। ১৮৭১ সালে ভিক্টোরিয়ার মা অ্যানি যখন তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন পত্রিকাগুলো এটিকে ‘দ্য ডার্টি সিক্রেট’ বলে অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ এবং অনাধিকার হস্তক্ষেপ করে। ১৮৭২ সালে হার্পার ম্যাগাজিন ভিক্টোরিয়াকে নিয়ে কার্টুন প্রকাশ করে এবং তাকে ‘মিস স্যার্টান’ বলে অভিহিত করে। কারণ তিনি নারী অধিকার, লিঙ্গ সমতা, মুক্ত যৌনতা এবং যৌন দাসত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন।
২০১৬ : পত্রিকা থেকে টিভি এবং ইন্টারনেটে আক্রমণ: ১৯৯০ থেকেই আমরা হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত জীবন, এমনকি কিশোরী চেলসি ক্লিনটনের উপর আক্রমণ হতে দেখেছি। এছাড়া যোগ হয়েছে তার স্বামীর সেক্স-স্ক্যান্ডাল। হিলারি গণমাধ্যমকে তার কন্যা চেলসিকে টেনে না আনার জন্য বলেন। তাবে গণমাধ্যম হিলারির প্রতিটি পদক্ষেপ, চিন্তা, উদ্দেশ্য গণমাধ্যম বিচার করতে থাকে। সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প হিলারিকে ‘হৃদয়হীন হিলারি’ এবং ‘অসাধু হিলারি’ বলে আক্রমণ করেন। কারণ তিনি বন্দুক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিলেন।
বর্তমানে নারী রাজনীতি এবং সমাজের কিছু ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টার কথা ব্যক্ত করছে। কিছু ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, আবার কিছু এক শতাব্দী আগের মতই আছে। যদি হিলারি জয় লাভ করেন আমেরিকা প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পাবে। কিন্তু এটি খুবই কষ্টের যে ১৪৬ বছর পরও আমাদের অগ্রগতি হয়নি। শতাব্দী এবং অর্ধ-শতাব্দী পর আমাদের সন্তানরাও এর জন্য যুদ্ধ করবে। সেই প্রজন্ম একদিন বলবে এখনো কেন ট্যাবুগুলোর অস্তিত্ব বিদ্যমান?
লেখক : ভিক্টোরিয়া উডহলের জীবনী ‘ম্যাডাম প্রেসিডেন্টস’ এর রচয়িতা চসার পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘নিকোলা ইভলিনা’। সম্পাদনা : আবু সাঈদ