রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার প্রধান সুফি কবি
আবু ফরহাদ
রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা দেখতে মৌলানা রুমির খিরকার মতোন। দীর্ঘ শশ্রুম-িত চেহারা, মাথার ওপর উঁচু টুপি যেটি সাধারণত সুফিরা পরতেনÑ তার ছিল এমনই এক অবয়ব। এই রকমের সৌম্য, শান্ত অবয়ব হতে যেন স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। তার এমন পোশাক পছন্দের পেছনে কি তার মনের মধ্যে ডুবে থাকা সুফি ভাবধারার আচ্ছন্নতা তাকে প্রভাবিত করেছে?
রবীন্দ্রনাথ বালক বয়সেই সুফি কবিতার সংস্পর্শে আসেন। পারস্যের হাফিজকে চিনতেন তিনি শৈশব থেকেই। রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দেওয়ানে হাফিজ আবৃত্তি করতেন। জানা যায়, তিনি দেওয়ানে হাফিজ মুখস্ত জানতেন। পিতার কাছ থেকে হাফিজের দেওয়ান শুনতে শুনতে তিনিও অলক্ষ্যে মরমীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সুফি ভাবধারা তাকে আকৃষ্ট করে। রবীন্দ্রনাথ নিজে এমনটি লিখেছেন যেÑ ‘আমি জানি যে হাফিজের ধর্মীয় দর্শন ও কবিতা আমার পিতাকে যতখানি অভিভূত করত, বৈষ্ণবদের দর্শন ও সঙ্গীত ততখানি করতে পারত না। হাফিজ ছিলেন তার ঐশ্বরিক আনন্দ। তিনি নিজে কবিতা লিখতেন না। হাফিজের কবিতাই তার সৃষ্টির আকাক্সক্ষাকে পূরণ করতÑ উপনিষদ তার ক্ষুধা নিবারণ করত এবং হাফিজ তার তৃষ্ণা মেটাত।’ পিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কথাকে যদি আমরা রবীন্দ্রনাথের নিজের জীবনের ভাবনা হিসেবে ধরে নিই তাহলেও তা খুব বেশি অত্যুক্তি হবে না। পিতার মতোন রবীন্দ্রনাথেরও হাফিজ ছিলেন ঐশ্বরিক আনন্দ এবং পারস্যের কবি হাফিজ যতখানি রবীন্দ্রনাথকে অভিভূত করতেন সম্ভবত আর কোনো কবি ততটা করতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথ তার পারস্য গ্রন্থে এ বিষয়ে তার মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। কবি হাফিজের সমাধির কাছে বসে তার এমনই অনুভূতি হয়েছিল যে হাফিজ ছিলেন তার অনাদিকালের বন্ধু, দোসর, যেন হাফিজ যা বলতে চেয়েছিলেন, তিনি তা-ই বলছেন এখন। কবি লিখেছেন, ‘এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যেও একটা চমক এসে পৌঁছল, এখনকার এই বসন্ত প্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চেখের সংকেত। মনে হলো, আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভর্তি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রুকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারেনি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধ প্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হলো আজ, কত শত বৎসর পরে জীবন মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফিজের চিরকালের জানা লোক।’
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসের দৃঢ়তায় যেভাবে বলেছেন, আমি হাফিজের চিরকালের জানা লোক তা সর্বাংশেই সত্য।
মহান স্রষ্টার প্রশংসা করতে গিয়ে সুফিদের মতোন রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টির সকল বস্তুতে, সকল ক্ষুদ্র কণা, অনু কণাতে সৃষ্টির তুচ্ছতম বস্তুটির মধ্যেও মহত্ত্বের সন্ধান করেছেন। ‘আজি যার জীবনের কথা তুচ্ছতম/ সেদিন শুনবে তাহা কবিত্বের সম।’ সুফিবাদ বিশ্ব জগতকে যেমন এক করে দেখে, জগতের সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে একই ছন্দ, একই লয় শুনতে পায়। রবীন্দ্রনাথের জগৎ ভাবনা ছিল এই রকমই। ‘এ বিশ্বরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে/ ছন্দ নাহি ভাঙ্গে তার সুর নাহি বাঁধে।’
সুফিদের জীবনের প্রধান স্বরূপ হচ্ছে দেহ মনের পরিশুদ্ধতা, পবিত্রতা। সুফিদের জীবন সাধনায় সংযম, কৃচ্ছসাধন, পরিশুদ্ধ জীবনযাপন অত্যন্ত অপরিহার্য। সুফি সাধনায় পার্থিব আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার অনবরত প্রচেষ্টা সবসময় বিদ্যমান। সুফিদের কামনায় কখনও পার্থিব জীবন বড়বেশি স্থান পায় না, সুফিরা পার্থিব ভোগবাদীতায় বিশ্বাসী নয়। সুফি ভাবনায় স্রষ্টার সঙ্গে মিলন এবং স্রষ্টাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলাই প্রধান। রবীন্দ্রনাথ জীবনের বস্তুগত আকর্ষণকে সবসময় সযতেœ পরিহার করেছেন। এটা খুবই আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, রবীন্দ্রনাথ খুব কম বয়সে তার স্ত্রীকে হারিয়েছেন। পরপর কয়েকটি মেয়ে ও ছেলেকে হারিয়েছেন। কিন্তু এত আপনজনদের মৃত্যু তাকে খুব বিচলিত করতে পারেনি। তিনি এসব মৃত্যুকে জীবনের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জীবনের সব আয়োজন, সকল বস্তুই যে ক্ষণস্থায়ী তা তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝতেন।
ফলে জীবনের কোনো বিষয়কে পাওয়ার ব্যাপারে তার প্রবল আগ্রহ কখনই ছিল না। ‘একজন সুফির মতোনই তার চিন্তাÑ এ জীবন মাত্র দুদিনের।’ তিনি যখন বলেন ‘যাদের চাহিয়া তোমারে ভুলেছি তারাতো চাহে না আমারে; তারা আসে তারা চলে যায় দূরে, ফেলে যায় মরু মাঝারে। দুদিনের হাসি দুদিনে ফুরায়, দীপ নিভে যায় আঁধারে, কে রহে তখন মুছাতে নয়ন ডেকে ডেকে মরি কাহারে। যাহা পাই তাই ঘরে নিয়ে যাই আপনার মন ভুলাতেÑ শেষে দেখি হায় সব ভেঙ্গে যায়, ধূলা হয়ে যায় ধূলিতে। সুখের আশায় মরি পিপাসায়, ডুবে মরি দুখ পাথারে-রবি শশী তারা কোথা হয় হারা, দেখিতে না পাই তোমারে।’
এরকম কবিতা পড়ার পর কি মনে কোনো দ্বিধা থাকে যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার প্রধানতম সুফি কবি নন?
লেখক : কবি ও ব্যাংক কর্মকর্তা
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন