জঙ্গিবাদ, শুধু বাংলাদেশেই নয়
স্বকৃত নোমান
জঙ্গিবাদ নামক যে সংকট বাংলাদেশে চলমান, তা কি শুধু বাংলাদেশের, নাকি বৈশ্বিক? পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লেবাননের কথা থাক। এই দেশগুলোতে তো প্রতিদিনই মানুষ মরছে। নতুন করে যুক্ত হলো ফ্রান্স, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ। এই কটি দেশে সম্প্রতি জঙ্গি হামলা হয়ে গেল। ভাবছি, বিশ্বজুড়ে এই রক্তপাতের শেষ আসলে কোথায়? নাকি সবে মাত্র শুরু? কারা শুরু করল? এই রক্ত রক্ত খেলার নেপথ্যে আসলে কে? আমেরিকা? অনেকেরই তো সন্দেহ দেশটিকে। মুসলমান নামধারীরা যেখানে যত অপকর্ম করছে সব দোষ আমেরিকার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। আফগানকা-ে কারা? আমেরিকা। সিরিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য কা-ে? তাও আমেরিকা। কী লাভ তাদের? তেল ছাড়া আবার কী? কিন্তু প্যারিসকা-ে? তাও আমেরিকা। কেন? শক্তিশালী ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দুর্বল করে দিতে হবে। ভাঙন ধরাতে হবে।
ঠিক আছে, আমিও না হয় সব দোষ দেশটির ঘাড়ে চাপিয়ে দেই। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে দেশটি রক্তের এমন হোলিখেলায় মেতে উঠল? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এই রাষ্ট্রটি কি বিপন্ন বোধ করতে শুরু করেছে? নিজের বিপন্নতা ঢাকতে কি বিশ্বজুড়ে হিংসার দাবানল ছড়িয়ে দিচ্ছে? প্রতিপক্ষ হিসেবে কি তারা মুসলিম বিশ্বকে নিল? তা তারা নিক। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব বা মুসলমানরা তাদের পাতা ফাঁদে পা দেবে কেন? মুসলমানদের কি কা-জ্ঞান নেই? আমেরিকা বললেই তারা হেমলকের পেয়ালা হাতে তুলে নেবে? তাদের মস্তিষ্কে কি খরা লেগেছে? কে তাদের রক্ষা করবে? নবুয়তের দরজা তো বন্ধ। কোনো নবী এসে তাদের উদ্ধার করবে সেই পথও তো খোলা নেই। নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগতে ভুগতে তারা কি পৃথিবী থেকে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে? কে জানে!
যে জাপান ক্ষমাশীল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার খাওয়ার পর যে জাপান কোনোরূপ সংঘাতে জড়াবে না বলে প্রতিশ্রুত, গুলশানকা-ের পর সেই জাপান কিনা বলছে এটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। ক্ষমা করা হবে না। পৃথিবীর সমৃদ্ধতম প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমি রোম বলছে, এর কঠিন জবাব দেওয়া হবে। দেশে দেশে এভাবেই জমা হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খেদ। একদিন কি এই খেদের বিস্ফোরণ ঘটবে না? ঘটবে তো নিশ্চয়ই। ইতিহাস তো তাই বলে। আকাশে কৃষ্ণ ভয়ঙ্করী মেঘের ঠাঁই না হলেই তো বজ্রপাত ঘটে। এই পুঞ্জীভূত খেদেরও বিস্ফোরণ ঘটবে একদিন। ঘটবেই। সেই বিস্ফোরণের নামই কি তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? অবস্থাদৃষ্টে তো তাই মনে হচ্ছে। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশ্বজুড়ে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, এখন কি তাই চলছে না? এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংঘাতগুলো কি বিশ্বকে জড়িয়ে ফেলবে না একটি মহাযুদ্ধে?
যদি তাই ঘটে, তাহলে কার সঙ্গে কার যুদ্ধ হবে? প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের? একদিকে আমেরিকা, অন্যদিকে এশিয়া? ইউরোপ কার পক্ষে যাবে? আর আফ্রিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্য? কত মানুষ নিহত হবে? ট্রেনের কত শত বগি বোঝাই করে কত লক্ষ লাশ ফেলে দেওয়া হবে ভূমধ্য, ভারত, আটলান্টিক, বঙ্গোপ কিংবা চীন সমুদ্রে? আচ্ছা, শেষ পর্যন্ত জয়টা কার হবে? আমেরিকার, না এশিয়ার? সভ্যতারও একটা গতিপথ থাকে। এই পথ কোনদিকে মোড় নেবে ইতিহাসে সেই সাক্ষ্য থাকে। ইতিহাস কি এই সাক্ষ্য দিচ্ছে জয়টা এশিয়ারই হবে? বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র কি এশিয়ার দিকে ঘুরবে? হয়তো। আমরা কি তবে প্রকৃতির সেই হতভাগ্য সন্তান, যারা এই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বলি হয়ে যাব? তাই-বা কেমন করে বলি? প্রকৃতি আরও বিস্তর হতভাগ্য সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যারা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংস বলি হয়ে গেছে। অর্থাৎ হতভাগ্য শুধু আমরা নই, আমাদের আগেও ছিল।
এসব কথার সবই আসলে ব্যক্তি আমি’র অনুমান। সংকটটাকে ভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখা। সত্যি হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু সংকট যে ক্রমশই ঘনীভূত হচ্ছে, এটি অনুমান নয়, বাস্তব। ক্রমশই অস্থিরতা বাড়ছে। এই অস্থিরতার কালে কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব? মনে হয় না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন