বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা দিয়েছেন ছায়াসঙ্গীর মতো
ফরিদুন্নাহার লাইলী
স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে অসামান্য অবদানের জন্য যে নারীর ত্যাগ, অবদান ও প্রেরণার কাছে ঋণী, তিনি হলেন তারই স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু তার জীবন ও যৌবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন জনগণের সেবায়, দেশের কল্যাণে। এই সময়কালে বেশিরভাগ সময় বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছে জেলে। আর সেই সময়গুলোতে কা-ারির মতো হাল ধরেছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
৮ আগস্ট এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এই দিনে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
ওই সময় মুসলিম ঘরের মেয়েরা ঘরের বাহিরে স্কুলে লেখাপড়া করত না বলে তিনি ঘরে বসে লেখাপড়া শিখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও, তিনি ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তার প্রভাব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর নিজের কথা থেকেই তা জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার পেছনেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছার। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’
‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণুÑ আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছিল। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ (আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-১)
বেগম ফজিলাতুন্নেছা একদিকে যেমন শক্ত হাতে সংসার ও সন্তানদের সামলিয়েছেন, তেমনি নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়াকে অতিক্রম করে স্বামীর সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে ছায়াসঙ্গীর মতো যুগিয়েছেন সাহস ও উদ্দীপনা। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। কারাবন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রায় দেড় বছর তাকে আটক করে রাখল। যেহেতু স্বামী কারাবন্দি, সেজন্য রেণুকে কেউ বাড়িভাড়া দিতে চাইত না। তিনদিনের নোটিশে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার মনের জোর ছিল প্রবল। দুঃসময়েও সবদিক লক্ষ্য রেখে শান্ত মনে নিজেই সামলাতে পারতেন সবকিছু। ছেলেমেয়ে নিয়ে বহু কষ্ট আর অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি সংসার চালিয়ে যেতে সমর্থ হন। নিজেই বাচ্চাদের কাপড় সেলাই করতেন। তাদের লেখাপড়ার দিকে লক্ষ্য রাখতেন। পিতার অভাবটা নিজের স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতেন। আবার তাকে মামলার খোঁজখবর নিতে আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। কারাবন্দি স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে হয়েছে। স্ত্রীর এই ত্যাগের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু একটি ঘটনার প্রসঙ্গে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’ (পৃষ্ঠা-১২৬)
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যে প্রেরণাদাত্রী হিসেবে ফজিলাতুন্নেছার অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ঘটনাটি ছিল এ রকমÑ এই ভাষণ দিতে যাবার আগে শেখ মুজিব কী বলবেন সে বিষয়ে অনেকে তাকে পরামর্শ, উপদেশ, চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফজিলাতুন্নেছা তাকে সভায় যাবার আগে ঘরে বিশ্রাম নেবার জন্য কিছুটা সময় একাকী থাকতে দেন। সে সময় তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘মনে রেখ, তোমার সামনে আছে জনতা এবং পেছনে বুলেট। তোমার মন যা চাইছে তুমি শুধু সেটাই আজ করবে।’ সেই শৈশব-কৈশোর থেকে তিনি শেখ মুজিবের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকা-ের সঙ্গে পরিচিত। শেখ মুজিবের স্ত্রী ও সহযাত্রী হিসেবে বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালির প্রতিষ্ঠা ছিল তারও লক্ষ্য। তাই ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব জনতাকে কি বলবেন, তা রেণুকেও আলোড়িত করেছিল।
শেখ মুজিবের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ফজিলাতুন্নেছার একটা দৃঢ়চেতা অথচ দরদি মন ছিল এবং ছিল আন্তরিক সহযোগিতা। বাঙালির অধিকার আদায় ছাড়া শেখ মুজিবের কাছে প্রধানমন্ত্রীত্ব বা ক্ষমতার কোনো আকর্ষণ ছিল না। ফজিলাতুন্নেছাও সেই আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন। সন্তানদের তৈরি করেন।
শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের রেণু ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। এসব কাজ তিনি নিজ উদ্যোগে করতেন। কখনও সরকারিভাবে কিছু চাইতেন না। নিভৃতচারী, ত্যাগী এ নারীকে জনগণ ‘বঙ্গমাতা’ হিসেবে সম্মানিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর আজন্ম জীবনসঙ্গী বেগম ফজিলাতুন্নেছা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে মারা যান। এই মহীয়সী নারীর কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য এবং ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন