ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ডানে মোড় কাম্য নয়
পল ক্রুগম্যান : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী সপ্তাহ দুয়েক মার্কিন নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দেওয়ার খুব একটা দরকার নেই। এখনো পর্যন্ত হিলারি ক্লিনটনের উত্তাপ ছড়াচ্ছে চারপাশে। কারণ ডেমোক্রেট কনভেনশনের পর ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে তার একটা উলম্ফন ঘটেছে। এক সপ্তাহ আগে তার প্রতিপক্ষ যে উলম্ফন পেয়েছিলেন, এটা তার চেয়ে একটু বেশি বৈকি।
ডেমোক্রেটদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে আমাদের বলতেই হয়, সাম্প্রতিক দৌড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বেকায়দায় পড়েছেন। তার কুৎসিত মন্তব্য আরও কুৎসিত হয়েছে। তার আজেবাজে মন্তব্য, তার নির্বাচনি সম্ভাবনাকে প্রায় ডুবিয়ে দিয়েছে। এর ফলাফল হলো, কিছু গুরুত্বপূর্ণ রিপাবলিকান কেবল ট্রাম্পের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেননি, বাস্তবত তারা হিলারি ক্লিন্টনের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এমন পরিস্থিতির প্রতি মিসেস ক্লিনটন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, তা-ই দেখার বিষয়।
অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হলো, কেউ হয়তো ভাবতে পারেন হিলারি ক্লিনটন আগে যেমন করছিলেন এখনো তেমনটিই করে যাবেন। তিনি গুরুত্ব দেবেন এটা প্রমাণ করতে যে, প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ট্রাম্প কতটা অযোগ্য, তার বন্ধু-মিত্রদের বলবেন তার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রচার চালিয়ে যেতে, আর একটি সহনশীল মধ্য-বাম নীতি নিয়ে এগুতে থাকবেন তিনি। যা বারাক ওবামার নীতির সঙ্গে অনেকখানি মিলে যাচ্ছে।
তবে কিছু বিশ্লেষক তাকে বলছেন এমন কিছু করতে যা খুবই ভিন্ন ধরনের। তারা বলছেন ডানপন্থার দিকে একটা দারুণ মোড় দিতে। ডেমোক্রেটদের নীতিকে সেই সব রিপাবলিকানদের পছন্দের দিকে ঘুরিয়ে দিতে, যারা ট্রাম্পের জাহাজডুবিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এ ধারণাটি সম্ভবত ইউরোপের মধ্য-বাম ও মধ্য-ডানের মধ্যকার মহাজোট গঠনের আমেরিকান সংস্করণ।
মনে হয় না, এ ধারণাটার ভবিষ্যৎ আছে। আর হিলারি ক্লিন্টন এমন কিছ বাস্তবতই করতে যাচ্ছেন। তবে এমন যদি হয় যে, হিলারি এবং তার চারপাশে ভিড় করা লোকজন এমনটা করতেই মরিয়া হন তবে কী হবে?
প্রথমেই পরিষ্কার করা যাক হিলারি ক্লিনটন এখন কী করছেন। তার চলমান নীতি প্রগতিশীল তবে তেমন চরম নয়। উল্লেখ করার মতো নীতি হলোÑ উচ্চ আয়ের মানুষের ওপর আরও বেশি করারোপ, তবে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে হারে কর বসানো হয়েছিল অবশ্যই তারচেয়ে বেশি নয়। তার প্রস্তাবিত সম্প্রসারিত সামাজিক কর্মসূচি আলোচিত হতে পারে। তবে এ কর্মসূচি ইউরোপীয় কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার ধারেকাছেও যায় না। হিলারি ক্লিনটনের শক্তিশালী অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বেশি পদক্ষেপ আলোচিত হতে পারে। তবে দুটো ইস্যুই একটু বেশি উচ্চকণ্ঠ বৈকি। আর এ কর্মসূচি দুটো খুব একটা প্রবৃদ্ধি-বান্ধব নয়।
ধনীদের ওপর থেকে কর কমানো এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক উদারিকরণকে ডানপন্থিরা প্রবৃদ্ধি-বান্ধব বলে মনে করেন। তবে এটা করলে প্রবৃদ্ধি বাড়ে এমন প্রমাণ কিন্তু হাতে নেই। আসলে সামাজিক নিরাপত্তা-জাল ব্যাপৃত করার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।
রিগ্যানের আমলের চেয়ে বিল ক্লিনটনের আমলে অর্থনীতি অনেক চাঙ্গা ছিল। ওবামার আমলে বুশের আমলের চেয়ে বেশি বেসরকারি কর্মসংস্থান হয়েছে। এমন কি, কর্মসংস্থান বেড়েছে কর বাড়ানোর পর আর ওবামামার সামাজিক নিরাপত্তা নীতি কার্যকর হয়েছে।
এটা সত্য যে, আমেরিকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বহু কিছু করার আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোÑ সরকারি ঋণ গ্রহণের মাত্রা কমানো। কারণ সরকারি ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া সরকারি বিনিয়োগের খরচ বাড়িয়ে দেয়। এ নীতিকে প্রগতিবাদীরা সমর্থন করলেও রক্ষণশীলরা বিরোধিতা করে। তাই, মধ্য-বাম নীতি প্রবৃদ্ধি-বিরোধী বলে মনে করছেন অনেকে।
এবার রাজনীতির ওপর আলোকপাত করা যাক। ট্রাম্প-নীতি রিপাবলিকানদের জন্য নতুন কিছু নয়। বরং বলা যায়, এটা হলো উন্মাসিক কৌশলের স্বাভাবিক পরিণতি। অনেক দিন আগে রক্ষণশীলরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবীদের মধ্যে প্রচার করবে ডানপন্থি অর্থনৈতিক নীতি, তাতে মেশাবে বর্ণবাদী উপাদান। বিশেষ করে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়। এ কৌশল অনেক স্থানের নির্বাচনে জয় এনে দেয়। তবে সবসময় শঙ্কার মধ্যে থাকতে হয় যে বর্ণবাদী উপাদান না আবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়! একারণে রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদদের সবসময় থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। আর তাদের ধারণাগুলোও তেমন জনপ্রিয় হয়নি। আর এটাই ছিল তাদের নীতির অবধারিত পরিণতি। এখনো ডানপন্থিরা যে নীতি প্রচার করছে, যে কৌশল অবলম্বন করছে, তা জনসমর্থনও পায়নি, সফলও হয়নি। বরং তা তাদের মুখে চপেটাঘাত হয়ে ফিরে এসেছে। প্রশ্ন হলোÑ ডেমোক্রেটদের কি এসব নীতির কিছু কিছু গ্রহণ করা উচিত?
এ বিষয়ে হয়ত সহায়তা করা যাবে না। তবে কিছু স্বঘোষিত মধ্যপন্থির কয়েটি সুপারিশের চরিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। রিপাবলিকানদের উত্থান পর্বে কিছু মধ্যপন্থি ডেমোক্রেটর বললেন, ডান দিকে সামান্য সরে আসতে। এখন ওই রিপাবলিকারা বিপদে আছেন। তাদের কেই কেউ মনে করছেন ডেমোক্রেটদের ভোট দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। এ অংশটিই এখন তারা ডেমোক্রেটদের বলছেন, কিছুটা ডানপন্থার দিকে সরে আসতে।
মূল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। ডান-বাম জোট কখনো কখনো রাজনীতির জন্য ভালো বলে দৃশ্যমান হয়। কোনো সংকট মোকাবিলার জন্য এটা প্রযোজ্য হতে পারে, যে সংকটের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল দায়ী নয়। যেমন জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি বাইরের হুমকি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইত্যাদি। কিন্ত আমেরিকাতে তো এমন কিছু ঘটছে না। ট্রাম্প-নীতি মূলত নয়া-রক্ষণশীল আন্দোলনের সৃষ্টি। যারা রাজনৈতিক ফায়দার জন্য আবেদনের চিনির আবরণ দেয়া ঘৃণার তেঁতো বড়ি বিক্রি করে জনগণের কাছে। তার পর তারা দেখতে পেয়েছে এমন একজন প্রার্থীকে যিনি আবরণ ভেঙ্গে বের হয়ে গেছেন।
কিছু রক্ষণশীল এ অবস্থাকে বেগতিক মনে করছেন। তারাই এ বিষয়ে দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছেন। তাদের সুস্থ ধারায় স্বাগত জানানো উচিৎ। কিন্তু এই ধারার লোকজন তাদের নীতির প্রতি আপস করবে না। যখন ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন চূড়ান্ত অর্থে বুঝতে পারলেন যে, তিনি এক দানব সৃষ্টি করেছেন, তিনি তখন আর পূরস্কৃত হননি। মিসেস ক্লিনটন ও তার দলকে নিজস্ব নীতিতে অটল থাকতে হবে। অনুবাদ : মোহসীন আব্বাস