
বিদ্যুৎ আইনের খসড়া আজ মন্ত্রিসভায় বেসরকারি খাতকে উৎসাহ ও বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে
হাসান আরিফ : বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ রেখে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ আইন ২০১৬। নতুন এই আইনে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ থাকছে। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও আমদানি-রপ্তানি সবই যাচ্ছে বেসরকারি খাতে। ১০৫ বছর পর এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎ আইন। ১৯১০ সালের ইলেকট্রিসিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী এতদিন দেশের বিদ্যুৎ খাত পরিচালিত হয়ে আসছিল। নানাবিধ সংস্কারের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিদ্যুৎ আইন ২০১৬-এর খসড়া তৈরি করেছে সরকার। আজ মন্ত্রিসভায় এই আইনটির খসড়া নীতিগত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনা করার কথা রয়েছে।
এ আইন অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। নিজস্ব স্থাপনায় ব্যবহারের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থায় বিতরণ লাইনও স্থাপন করতে পারবে। একইসঙ্গে সরকারি-বেসরকারি এসব স্থাপনা রক্ষায় নতুন আইনে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।
খসড়া আইনে বলা আছে, নাশকতার উদ্দেশ্যে কেউ বিদ্যুৎকেন্দ্র, উপকেন্দ্র, বিদ্যুৎ লাইন, খুঁটি ও সঞ্চালন যন্ত্রপাতিতে কোনো বস্তু নিক্ষেপ করলেই ৬ মাসের কারাদ- দেওয়া হবে। একইসঙ্গে এ ধরনের অপরাধে কেউ প্ররোচনা ও সহায়তা দিলে তার বিরুদ্ধেও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে অন্তর্ঘাতমূলক মামলা ও শাস্তি হবে। সরকারি কর্মচারি-বেসরকারি সংস্থা, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিদের বেলায়ও একই আইন প্রযোজ্য হবে। শুধু তাই নয়, এই আইনে অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিষয়টি ধামাচাপা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সংস্থার বিরুদ্ধেও প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন আইনে অবশ্যই সরকারি খাতকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে সরকারের হাতে। তবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়ন, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরের রূপকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অত্যাবশ্যক। কিন্তু বিদ্যমান অবকাঠামোতে জ্বালানি ও বিদ্যুতের অপর্যাপ্ত সরবরাহ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তাই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য সরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে বদ্ধপরিকর। নতুন বিদ্যুৎ আইন ২০১৬-এর খসড়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
নতুন বিদ্যুৎ আইনে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানিতে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহ দেওয়া হবে। এই আইনে বিদ্যমান সরকারি বিদ্যুৎ লাইন ব্যবহার করে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে। বিলের টাকাও সংগ্রহ করতে পারবে। বিদ্যমান বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোসহ ভবিষ্যতে ব্যক্তি খাতে যেসব কেন্দ্র গড়ে উঠবে, সবকটিকে এ সুযোগ দেবে সরকার। বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে। এজন্য সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করবে।
খসড়া আইনে রয়েছে, যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। নিজস্ব স্থাপনায় ব্যবহারের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থায় বিতরণ লাইনও স্থাপন করতে পারবে। এতে বেসরকারি খাতে কেউ শিল্প-কারখানা করতে আগ্রহী হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে দর কষাকষির মাধ্যমে ট্যারিফ ঠিক করে যেকোনো মুহূর্তে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারবে। শুধু তাই নয়, সরকার নির্ধারিত দরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকারি বিতরণকারী কোম্পানি বা সংস্থার কাছে বিক্রি করা যাবে। বিদ্যমান ও নতুন বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনের জন্য সরকারি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ব্যবহার করা যাবে। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। একইসঙ্গে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাওয়ার মার্কেট ও সিঙ্গেল বায়ার প্রতিষ্ঠার সুযোগ রাখার কথাও রয়েছে খসড়া আইনে। ফলে বিদ্যুতের উন্মুক্ত বাজার থেকে যেকোনো ক্রেতা চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ কিনতে পারবেন।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নতুন আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। পরে তা জাতীয় সংসদে বিল আকারে পাস হতে পারে। এ আইন পাস হলে ১০৫ বছরের পুরনো বিদ্যুৎ আইন বাতিল হয়ে যাবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলেও গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ ও সরবরাহ করার সুযোগ পায় না। সঞ্চালন ও বিতরণ খাত দুটি এককভাবে পরিচালনা করছে দেশের রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানি ও বোর্ড। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নিয়ে তা সঞ্চালন ও বিতরণ করছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো। নতুন আইন হলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেসরকারি খাতে লাইসেন্স দেওয়া হবে। সরকারের অনুমতি নিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিদেশে রফতানিও করতে পারবে। একইসঙ্গে বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে। এই আমদানি বা রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের বিদ্যমান সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হবে ওই প্রতিষ্ঠানকে।
আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এটি আইনে রূপান্তরিত হলে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়ে সরকারের অনুমোদনক্রমে বেসরকারি খাত বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। বিদ্যমান ও নতুন বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনের জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ সংস্থাগুলোর লাইন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে। এ খাতগুলোতে দেশি ও বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকার প্রতিযোগিতামূলক এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য এবং অপ্রচলিত জ্বালানি ব্যবহারে সরকারের উৎসাহ দেওয়ার কথাও খসড়া আইনে বলা হয়েছে। এজন্য আলাদা একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহারকারীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এছাড়া স্মার্ট গ্রিড স্থাপনের মাধ্যমে গ্রিড বিপর্যয়ের সময় সারাদেশ একসঙ্গে অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি রোধ করার কথা বলা হয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত সঞ্চালন বা বিতরণ লাইন বিচ্ছিন্ন করলেই গ্রিড বিপর্যয় মোকাবিলা করা যাবে। এই আইনে সারাদেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সমন্বিত আকারে পরিচালনার জন্য সরকার একটি ইন্ডিপেনডেন্ট সিস্টেম অপারেটর প্রতিষ্ঠা করবে। একইসঙ্গে পুরো দেশে টেকসই, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা বা কোম্পানিগুলোর জাতীয় গ্রিড সিস্টেমকে স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
খসড়া আইন অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হলে তাকে ১০ দিন আগে লিখিত নোটিস দিতে হবে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর সংশ্লিষ্ট গ্রাহক যদি ক্ষতিপূরণ দেন তাহলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দুদিনের মধ্যে তার বিদ্যুতের লাইন পুনঃসংযোগ করে দিতে হবে। কোনো গ্রাহক নির্দিষ্ট মাসে বা সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না চাইলে তা সংশ্লিষ্ট বিতরণ কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করলে ওই সময় পর্যন্ত তার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হবে। গ্রাহককে ওই সময়ের বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে না, শুধু সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। এছাড়া গ্রাহক চাইলে বিদ্যুতের অগ্রিম বিলও দিতে পারবেন।
খসড়া আইনে উল্লেখ রয়েছে, বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনে জাতীয় বিদ্যুৎ নীতি প্রণয়ন করতে পারবে। এই নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নসহ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। একইভাবে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। বিদ্যুৎ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রাহককে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান, গুণগত মানের বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে সরকার বিদ্যুৎ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পুনর্বণ্টন করতে পারবে। বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে সরকার ইচ্ছা করলে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য এক বা একাধিক বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ বোর্ড বা হোল্ডিং কোম্পানি গঠন করতে পারবে। খসড়া আইনে অবৈধ বিদ্যুৎ বিতরণ বা ব্যবহারকারীকে অনধিক দুই বছরের কারাদ- বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ১০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ চুরির জন্য ৩ বছর, ১০ কিলোওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ চুরির জন্য ৫ বছরের কারাদ-, এছাড়া ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ৬২ শতাংশ। অপরদিকে বেসরকারি খাতে বেড়েছে ১৬৯ শতাংশ। তবে নতুন আইনে বেসরকারি খাত কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি করবে তা স্পষ্ট করে দিতে হবে। সরকারি গ্রিড ব্যবহারের বিষয়টিও স্পষ্ট করতে হবে। সম্পাদনা: আ. হাকিম
