তথ্য অধিকার আইনে থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন
ইকতেদার আহমেদ
পৃথিবীর যে সকল দেশ জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার দলিল, ১৯৪৮ এ স্বাক্ষর করেছে তার অধিকাংশই তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের নিমিত্ত তথ্য অধিকার বিষয়ক আইন প্রণয়ন করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। তবে বাংলাদেশের তথ্য অধিকার সংক্রান্ত আইনটি প্রণীত হয়েছে ২০০৯ সালে।
বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইনে যে সকল তথ্য প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরাপ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ (ক) বাংলাদেশের নিরাপত্তা, অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব হুমকি হতে পারে এমন তথ্য; (খ) বিদেশি রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষুণœ হতে পারে এমন তথ্য; (গ) বিদেশি সরকারের নিকট হতে প্রাপ্ত কোনো গোপন তথ্য; (ঘ) তথ্য প্রকাশের কারণে কোন বিশেষ ব্যক্তি লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন তথ্য; (ঙ) কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত, জনগণের নিরাপত্তা বিঘিœত, ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুণœ, জীবন বা শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হয় এমন তথ্য; (চ) আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক গোপনে প্রদত্ত কোনো তথ্য; (ছ) আদালতে বিচারাধীন বিষয়কে প্রভাবিত করে এমন তথ্য; (জ) তদন্ত কাজে বিঘœ ঘটতে পারে এবং একজন অপরাধীর গ্রেফতার ও শাস্তিকে প্রভাবিত করে এমন তথ্য; (ঝ) কৌশলগত ও বাণিজ্যিক কারণে গোপন রাখা বাঞ্ছনীয় এরূপ কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য; (ঞ) জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিকারহানির কারণ হতে পারে এমন তথ্য; (ট) কোনো ব্যক্তির আইন দ্বারা সংরক্ষিত গোপনীয় তথ্য; (ঠ) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বা পরীক্ষায় প্রদত্ত নম্বর সম্পর্কিত আগাম তথ্য; (ড) মন্ত্রীসভায় উপস্থাপিত সার-সংক্ষেপসহ আনুষঙ্গিক দলিলাদি বিষয়ক তথ্য প্রভৃতি।
উপরোল্লেখিত তথ্য ব্যতীত অপর সকল বিষয়ে তথ্য জানার অধিকার আইন দ্বারা স্বীকৃত। এ আইনটিতে কোনো কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হলে অনধিক ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আইনটিতে তথ্য অধিকার বিষয়ক যেকোনো অভিযোগ নিষ্পত্তিসহ তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠার উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন পরবর্তী যথারীতি তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে কমিশন যে দেশের সাধারণ জনমানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এ ধরনের কথা বলার অবকাশ কমিশন অদ্যাবধি সৃষ্টি করতে পারেনি।
দেশে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের পর ২০১৪ সাল জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। যদিও জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে, নীতিমালাটি জনগণের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সমুন্নত রাখাসহ গণমাধ্যমসমূহের স্বাধীনতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে প্রণীত কিন্তু নীতিমালাটিতে এমন কিছু তথ্য সম্প্রচারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে যা তথ্য অধিকার আইনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ব্যহত করে। উদাহরণস্বরপÑ নীতিমালাটিতে বলা হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী অথবা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত দায়িত্বশীল অন্য কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ, বিদ্রুপ বা অবমাননাকর, অপরাধ নিবারণ ও নির্ণয়ে অথবা অপরাধীদের দ- বিধানে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে এমন দৃশ্য প্রদর্শন বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। নীতিমালার এ বিষয়টি অবলোকন করলে প্রতীয়মান হয় সশস্ত্র বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীসমূহের বিষয়ে তথ্য সম্প্রচারের বিষয়ে আরোপিত বিধিনিষেধ প্রকারান্তরে এ সকল বাহিনীর অনেক বেপরোয়া সদস্যকে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
দেশে তথ্য প্রকাশকারীকে আইনগত সুরক্ষা প্রদানের জন্য ২০১১ সালে তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন প্রণয়ন করা হলেও তথ্য প্রদানকারীরা যে যথাযথ আইনের সুরক্ষা পাচ্ছেন সে বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আদালতে সত্য প্রকাশ করে অথবা প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে রাষ্ট্রপক্ষ বা প্রতিপক্ষ দ্বারা যে হয়রানির শিকার হয়েছেন এ বিষয়টি আজ আর কারও অজানা নয়। বহুল আলোচিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কারাগারে আটক সুখরঞ্জন বালীর বিষয়টি এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে অগণিত ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ক্রসফায়ারের পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ হতে যে বক্তব্য প্রদান করা হয় তাতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধীসমেত তার দেখানো মতে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়লে অপরাধী ক্রসফায়ারে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সরকারি দায়িত্ব পালনকালে কোনো উশৃঙ্খল জনতা বা কোনো ধরনের সন্ত্রাসী বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে তাদেরকে নিবৃত্ত করার জন্য কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে তা আইন দ্বারা নির্ধারিত। প্রতিটি ক্রসফায়ারে একই ধরনের গল্প আইনের নির্ধারিত সীমার অপপ্রয়োগে যে সাজানো হয় এ বিষয়ে দেশের গণমাধ্যমসহ সচেতন জনমানুষের স্পষ্ট ধারণা থাকলেও তা রোধ করা কেন সম্ভব হচ্ছে না এ তথ্য জানার অধিকার কি দেশবাসীর নেই?
যেকোনো দেশে তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করা গেলে তা দেশে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করবে যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রকে সুসংহত করবে। প্রতিটি আইন প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই প্রণীত হয়েছে। কিন্তু এ আইনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে আমরা যে এখনও অনেক দূরে এ বিষয়ে দেশের সাধারণ জনমানুষের মধ্যে কি কোনো দ্বিমত আছে?
লেখক : সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন