
কোন গন্তব্যে বিএনপির নতুন কমিটি?
সাম্য শরিফ : অবশেষে নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটির নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। সর্বমোট ৫০২ সদস্যের এক বিশাল কমিটি। কমিটি বড় হওয়ায় অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। ষোলো কোটি জনসংখ্যার এই দেশে অন্যতম প্রধান দল হিসেবে এরকম বড় কমিটি বিএনপি করতেই পারে। আবার রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির নেতৃত্বের প্রতিটি স্তরে এবং প্রত্যেক নেতার স্থলে একাধিক বিকল্প নাম থাকাটা এখন দলটির জন্য সময়ের দাবি। কারণ বিএনপির অধিকাংশ নেতাই এখন জামিনে রয়েছেন। সাজা হলেই জেলে। আবার নতুন যেকোনো মামলায় আটক হতে পারে মুহূর্তেই। সেক্ষেত্রে বিকল্প ভাবনা থাকলে সাময়িক নেতৃত্বশূন্যতা এড়াতে পারবে। বিএনপি ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন যে সময় অতিবাহিত করছে তা হয়ত দীর্ঘতর হবে। কারণ প্রতিপক্ষ এখন অনিবার্য ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’। আর রাজপথে ব্যর্থ বিএনপির সাথে সরকার কখনো সংলাপে বসবে না। সুতরাং রাজপথের সফলতা ছাড়া বিএনপির সুদিন ফেরার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় বিএনপির নতুন কমিটির সামনে এখন কোন গন্তব্য Ñ রাজপথ কিংবা জেলখানা, না অন্যকিছু?
বিএনপির কমিটির আকার কিংবা নেতৃত্বের চেয়ে বড় বিষয় এখন এই কমিটির গন্তব্য। রাজনীতির অস্বাভাবিক এ সময়ে বিএনপির এ কমিটি এখন কয়েকটা ঝুঁকি এবং দায়বদ্ধতার উপর রয়েছে। বিএনপির কমিটির সদস্যদের প্রথম ঝুঁকি তারা কতক্ষণ মুক্ত বাতাসে থাকতে পারবেন। আর দায়বদ্ধতা হচ্ছে তারা দেশবাসীর হয়ে সঠিক রাজনীতির মাধ্যমে দেশে স্বাভাবিক রাজনীতি ফেরাতে সক্ষম হবেন কিনা। একদিকে বন্দি জীবনের সম্ভাবনা আর অন্যদিকে দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর কঠিন দায়িত্ব নিয়ে বিএনপির বর্তমান কমিটি কতটা সামনে যেতে পারবে তার উপর নির্ভর করছে এর অস্তিত্ব ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র। সুতরাং এই কঠিন সময় বিএনপির এ বর্তমান কমিটির প্রথম কাজ তাদের গন্তব্য ঠিক করা। গন্তব্য যদি রাজপথ কিংবা জেলখানা হয় তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু ‘অন্যকিছ’ু হলে অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে। কারণ দল গোছানোর পর বর্তমান বাংলাদেশে বিএনপির জন্য রাজপথ কিংবা জেল ছাড়া আপাতত কোনো রাজনীতি নেই। প্রতিপক্ষ হয়ত একটি বিষয় খুব উপভোগ করে যে বিএনপি এ দুটোই এড়িয়ে চলতে চায়!
অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের দেশে রাজনীতি, রাজপথ এবং জেলখানা বৃষ্টিপাত, ভূপৃষ্ঠ ও-বৃক্ষ ফসলের মতই একই লক্ষ্যে ও পরিণতিতে আবর্তিত। তাই গণতন্ত্র ফেরানোর এ সময়ে বিএনপির রাজনীতিতে আপাতত রাজপথ ও জেলখানা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপিকে এখন রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে সুসংগঠিত হয়ে রাজপথে আসতেই হবে। আবার রাজপথে আসার অনিবার্য পরিণতি হতে পারে হাজতবাস। নতুন কমিটির কোনো সদস্য যদি সে পরিণতিকে ভয় পায় কিংবা এড়িয়ে চলে তাহলে এখন বিএনপিতে তার প্রয়োজন কি? বিএনপি বিগত কয় বছরে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা বিনষ্ট করেছে দৌড় ও আত্মগোপনের মাধ্যমে। তৎকালীন বিরোধী দলীয় চিপ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুক পুলিশের লাঠির ভয়ে যে ক্লাসিকাল দৌড় প্রদর্শন করেছিলেন তাতে রাজনীতীবিদদের ইমেজ নষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে আত্মগোপনের যে কালচার বিএনপি সৃষ্টি করেছে তা রাজনীতিবিদদের জন্য সম্মানজনক নয়। জেলখানা ও পুলিশের ভয় পেতে পারে একজন ক্রিমিনাল, রাজনীতিবিদ কেন? বিএনপির এই নতুন কমিটিতে যদি সেরকম দৌড়বিদ বা আত্মগোপনপ্রিয় ও আরামবাদী ভিতু সদস্য থাকে তাহলে অতীতের মতো একই পরিণতির শিকার হবে বিএনপি।
বিএনপির রাজনীতি এখন আর নিজের জন্য নেই। কারণ ভোট না ফেরা পর্যন্ত ক্ষমতার পথ রুদ্ধ। আর ভোট শুধু বিএনপির নয়, গোটা দেশবাসীর। বিএনপিকে এখন সেই দেশবাসীর রাজনীতি করতে হবে। গণতন্ত্রের পক্ষে, ভোটের পক্ষে, সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনীতির পক্ষে দেশবাসীকে একতাবদ্ধ করাটাই বিএনপির প্রধান কাজ। বিএনপির একমাত্র রাজনীতিও এখন দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে ভোটাধিকারের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে নামা। আর এটা করতে গিয়ে যতরকমের ত্যাগ আছে তা স্বীকার করতে হবে। তবে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার আগে বিএনপির নিজেরও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। বি. চৌধুরী ও অলি আহমদরা আর কতদিন বাইরে থাকবেন? সংস্কারবাদী নেতাদের একজন স্থায়ী কমিটিতে স্থান পেলেও অন্য দুজন ভাইস চেয়ারম্যান হতে পারলে অন্যদের কেন ফেরানো হবে না?
বিএনপির নতুন কমিটির সব নেতা রাজপথে এসে জেলে যাক, ক্ষতি নেই। তাতে রাজনীতি বেঁচে থাকবে। আন্দোলন বেগবান হবে। নেতারা জেলে গেলে কর্মীরা নেতা হয়ে যায়, কিন্তু নেতা পালালে কর্মীরা লজ্জায় ঘরে উঠে যায়। এই মহাক্রান্তিলগ্নে রাজপথ ও জেলখানার বাইরে বিএনপির এই নতুন কমিটির কেউ যদি বিগত দিনের মতো অন্য কোনো নিরাপদ আশ্রয় কিংবা গোপন ঠিকানার সন্ধানে থাকেন তাহলে রাজনীতির মর্যাদার দিকে তাকিয়ে তার এখনই পদত্যাগ করা উচিৎ।
লেখক মানবাধিকার সংগঠন ‘দি হান্ড্রেড’-এর প্রতিষ্ঠাতা
