পনেরো আগস্ট ও কিছু কথা…
মুজিবুর রহমান হাওলাদার
আঠারোই জানুয়ারি ১৯৭৩ মোতাবেক ২রা পৌষ ১৩৭৯। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সফরে পিরোজপুর আসবেন। বঙ্গবন্ধুর জনসভার কথা শুনে ২-৩ দিন আগে থেকেই চাল-ডাল নিয়ে নৌকায় রওয়ানা দিয়েছেন দূরের থানার লোকজন। আর ওইদিন প্রচ- শীতকে উপেক্ষা করে সূর্যোদয়ের এক ঘণ্টা আগেই রওয়ানা করেছেন পার্শ্ববর্তী এলাকার জনগণ। যেন এক মহা আনন্দের দিন। সকলের লক্ষ্য ছিল, পিরোজপুর সরকারি স্কুল ময়দান। বলতে গেলে সূর্যোদয়ের আগেই ময়দান লোকে লোকারণ্য। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গবন্ধুর সভামঞ্চের সামনে অনেক দূর পর্যন্ত বাঁশের বেড়া। বাঁশের বেড়ার ওপাশে জনগণ। আবার রয়েছে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর কঠিন প্রহরা। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি খানিকটা বিলম্বিত হওয়ার কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অনর্গল বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ঘটল। ’জয়বাংলা’ সেøাগানে আকাশ- বাতাস মুখরিত। কিন্তু নেতা যে অনেক দূরে। অথচ নেতাকে নিকট থেকে দেখার অদম্য কৌতূহল জনতার। গণমানুষের নেতা জনগণের অস্থিরতা অনুভব করলেন। স্বভাবসুলভ বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ওদের আসতে দাও, ওদের আসতে দাও’। আজ তেতাল্লিশ বছর পরেও যেন সেই বজ্রকণ্ঠের আহ্বান এখনও কানে বেজে ওঠে। প্রিয় নেতার আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে কোথায় বাঁশের বেড়া, আর কোথায় সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী, সবকিছু দলিত-মথিত করে একেবারে বিশাল জনস্রোত আছড়ে পড়ল বঙ্গবন্ধুর মঞ্চের সামনে। সেই আবেগাত্মক ঘটনা আজ অবিস্মরণীয়।
এ সময় তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি। সুউচ্চ বিশাল প্রাচীর ঘেরা বঙ্গভবনের মতো নিরাপদ এলাকায় তার থাকার কথা। বাঙালিকে বিশ্বাস করে তা তিনি করেননি। থেকেছেন নিজের বাড়িতে যেখানে ছিল না তেমন কোনো নিরাপত্তা। শুধু ছিল জনগণের প্রতি বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের মূলে ছিল বাঙালির জন্য তার কঠিন ত্যাগ। কঠিন ত্যাগের বিনিময়ে বাঙালির জন্য করেছেন এক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের কলোনিগুলো যখন জাতিরাাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতে থাকে সেই ধারাবাহিকতায় আমরা পেলাম পাকিস্তান। আজকের বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্র হওয়ার সকল উপাদান থাকলেও পাকিস্তানি নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রভাবে তা সম্ভব হয়নি। নির্দিষ্ট ভূখ-, জনগণ, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য একটা জাতির জন্য যা থাকা দরকার সব কিছু থাকার পরেও হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশ শাসন করেছে তুর্কি সুলতান, মোগলের সুবাদার, বৃটিশের লর্ড ও পাকিস্তানি সামরিক শাসক। প্রজা হিসেবে আমরা হয়েছি শাসিত। একেবারে বিদেশি শাসন। তিনটি বিদেশি ভাষার শাসন। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে কোনো স্বীকৃতি ছিল না। এই বিদেশি শাসনের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য জেল-জুলুম, দৈহিক নির্যাতন উপেক্ষা করে যিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, এনে দিয়েছেন বিশ্ব স্বীকৃতি, তিনিই তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী, জিন্নাহ, সূকর্ণের মতোই আমাদের জাতির পিতা। কিন্তু কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক সেই পবিত্র বিশ্বাস ভঙ্গ করে সৃষ্টি করেছে ১৫ আগস্ট।
উদার মানসিকতার পাশাপাশি ছিল তার দুর্দমনীয় সাহসিকতা। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে ফিরে তখনকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় ভাষণের এক পর্যায়ে করা তার সাহসী উক্তি প্রণিধানযোগ্য। ‘আমি আমেরিকার জনসাধারণকে সালাম জানাই, কিন্তু নিক্সনকে নয়।’ রিচার্ড নিক্সন তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এক খলনায়ক। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে লন্ডনে এসে সবকিছু শুনে আমেরিকার নিক্সন-কিসিঞ্জারের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আচরণে হয়েছিলেন ব্যথিত। আর জনসাধারণের ভূমিকায় হয়েছিলেন মুগ্ধ। তাই দেশে ফিরে ক্ষোভ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষায় ছিল এরূপ সাহসী উচ্চারণ। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারিতে নিক্সন ক্ষমতা হারালেও কিসিঞ্জার ছিল বহাল তবিয়তে। বঙ্গবন্ধুকে তারা মেনে নিতে পারেনি।
শুধু কি তাই? ১৯৭৩ সালে চিলির নেতা সালভেদর আলেন্দেকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে এক সামরিক শাসক। প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার অবস্থা যদি আলেন্দের মতোও হয়, তবু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে মাথানত করব না’। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি ছিল তার কঠিন চ্যালেঞ্জ। তাই তো পথ থেকে খাদ্য জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে প্রাণহারী দুুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে ব্যঙ্গ করে তছনছ করে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি। তাতেও তাদের প্রতিশোধের আগুন নিভেনি। শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এদেশীয় দোসর খোন্দকার মোশতাক আহমদ, মাহবুব আলম চাষী, তাহের উদ্দীন ঠাকুররা ষড়যন্ত্রের চরম খেলায় মেতে ওঠে। ক্ষমতার নেশায় এদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় কয়েকজন সেনা অফিসার। পেছনে কলকাঠি নাড়তে থাকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এদেশীয় এজেন্ট। ষড়যন্ত্রের ষোলকলা শেষ। হানে চরম আঘাত। আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধু, একমাত্র ভ্রাতাসহ চাকর-বাকর নিয়ে খুন হয় অনেক নর-নারী। দোতলার সিঁড়িতে পড়ে থাকে বঙ্গবন্ধুর লাশ। বিধির বিধান অনুযায়ী বেঁচে যান যোগ্য উত্তরসুরী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
খোন্দকার মোশতাক, মাহবুব আলম চাষী, তাহের ঠাকুর এরা কারা? আস্তিনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাপ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামদের ভীষণভাবে বিরক্ত করেছেন। প্রো আমেরিকান এই দলটি সবসময় পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপোস করার তালে ছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার দোহাই দিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে কনফেডারেশন করার নামে তাজউদ্দীন সাহেবদের বিরোধিতা করাই ছিল এদের কাজ। তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলে খোন্দকার মোশতাক তাকে সহ্য করতে পারেনি। সবক্ষেত্রেই করেছে বিরোধিতা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর ফিরে এলে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করতে থাকে। ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে আসুক তাজউদ্দীন আহমদ তা চায়নি’ এরূপ কথা বলতেও খোন্দকার মোশতাকের বিবেকে বাধা দেয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর মন্ত্রীসভা হতে বিদায় নিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ চলে যাওয়ার পর লুকিয়ে থাকা আস্তিনের সাপগুলো ফনা তুলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ হয়ে যায়। তাজউদ্দীন আহমদকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ১৫ আগস্ট সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করেছে খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে গঠিত ষড়যন্ত্রী দল।
১৫ আগস্ট যতই এগিয়ে আসছে, ততই এসব কথা মনে পড়ছে। সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে তিনি তো কম করেননি। ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এনেছেন বিশ্ব স্বীকৃতি। দিয়েছেন সংবিধান। মেরামত করেছেন সড়ক, জনপথ ও রেলসেতু। সচল করেছেন সমুদ্রবন্দর। সকল ধরনের জাতিগঠনমূলক বিভাগকে করেছেন সচল ও কর্মমুখী। করেছেন শরণার্থীদের পুনর্বাসন। বাংলাদেশকে করে গেছেন বিশ্ব সংস্থাসমূহের সদস্য। তারপরও আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, সূকর্ণের মতো অসময়ে চলে যেতে হয়েছে। তবে এই লাল সবুজ পতাকা, জাতীয় প্রতীক, জাতীয় সংগীত, সংবিধান, মুদ্রার নামকরণ ও অন্যান্য জাতীয় মৌলিক বিষয় যা তিনি নির্ধারণ করে গেছেন এর মধ্যেই তিনি থাকবেন চিরঞ্জীব। আর বাংলাদেশ, যে যাই বলুক এটা বঙ্গবন্ধুরই সৃষ্টি।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন