শিল্পী এস এম সুলতানকে আমরা কতটুকু জানি?
আজ আমার লেখার বিষয়বস্তু দেশের গুণী মানুষদের প্রতি আমাদের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্পর্কে। আমরা শিল্পী এস এম সুলতানকে চিনি কিন্তু আমরা তার শিল্পকর্ম সম্পর্কে কতটুকু জানি? শৈশব থেকেই তার কাছে যাবার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। আমি নিজে তাকে বড় বড় ছবি আঁকতে দেখেছি তার বাসায়। ‘শিশু স্বর্গের’ বাচ্চাদের নিয়ে আঁকার সময় আমি তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছি নড়াইলে। কলেজে পড়বার সময় শিল্পী এস এম সুলতানের নিকট প্রতিবেশী প্রফেসর হাসান দেওয়ান স্যারের বাড়িতে পড়তে যাওয়ার সময় চিত্রানদীর তীরে তার স্বপ্নের নৌকা বানানো দেখেছি দিনের পরদিন দাঁড়িয়ে থেকে।
তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার শিল্পকর্মগুলো দেশের শিল্প সংস্কৃতিকে করেছে সম্মৃদ্ধ। অথচ এই শিল্পী সুলতানকে জীবদ্দশায় আমরা কতটুকু প্রাপ্য সম্মান দিতে পেরেছিলাম? উনি যতটুকু সম্মান পেয়েছিলেন সেটা ছিল তার জীবনের শেষের দিনগুলোতে। অথচ জীবিত সুলতানের থেকে যেন মৃত সুলতানই বেশি আলোকিত করেছে আমাদের। আমরা কি কখনও তার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি? বোধ করি যতসামান্য লোকেই তার সম্পর্কে সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী এস এম সুলতানের নিজের মুখে বলা একটি উক্তিতেই ফুটে ওঠে তার নিজ সম্পর্কে তার নিজের মূল্যায়ন। একদিন তার খুব কাছের শিষ্য বর্তমান পটচিত্র শিল্পী নিখিল চন্দ্র দাস রাজশাহী থেকে ফিরে এসে গুরু সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে এলে গুরু সুলতান শিষ্যের কাছে রাজশাহীর সবাই কেমন আছেন জানতে চান, বিশেষভাবে তিনি উল্লেখ করেন রাজশাহী আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল জনাব বনিজুল হক এর কথা। সুলতান তাকে বনিজুল হক ভাই বলে সম্বোধন করতেন। এরপর তিনি শিষ্য নিখিল চন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন, তার নিজের বিষয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা বা খোঁজ করেছে কিনা? এর জবাবে নিখিল চন্দ্র ‘না’ সূচক জবাব দিলে সুলতান আনমনে বলে ওঠেন, ‘খুঁজবে, খুঁজবে সুলতান মরে গেলে সবাই একদিন খুঁজবে’। তার উক্তি শুনলেই সামগ্রিক মনের অবস্থার চিত্রই ভেসে ওঠে। কাছের মানুষদের সম্পর্কে জানার তার এই যে ব্যাকুলতা এটা প্রমাণ করে, তিনি তার কাছের মানুষদের কাছে থেকে ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন। তার কাছের শিষ্যদের মধ্যে বর্তমানে শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস, শিল্পী নিখিল চন্দ্র, হানিফ শেখ (ঘনিষ্ঠ সহযোগী), শিল্পী সমীর মজুমদার অন্যতম। গুরুর স্মৃতি আকড়ে ধরে কেমন আছেন তারা? কেউ কি আমরা তাদের খোঁজ করি? কেমন করে তারা তাদের গুরুর আশির্বাদপুষ্ট হয়ে সেই শিল্পকর্মকে আকড়ে ধরে দেশের চিত্রশিল্পের ভা-ারকে করছে সম্মৃদ্ধশালী।
যারা দিনে রাতে নিজেদের ব্যস্ত রাখছে শিল্প সৃষ্টিতে, জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করছে শিল্পকর্ম তৈরিতে। শত অভাবের ভিতর সংসার জীবনের কথা ভুলে যেয়ে দেশের শিল্প সংস্কৃতকে সম্মৃদ্ধ করে চলেছেন তারা। তাদের এই অবদানের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা দায়িত্ব সকলের। কারণ এই গুণী মানুষগুলো তাদের শিল্পের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে এই নড়াইল জেলাকে তুলে ধরে। সেদিন শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাসের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলাম এবং নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তাদের এই যে দূরত্বটা সৃষ্টি হয়েছে তার দায়ভার কার? শিল্পী এস এম সুলতান বা বিমানেশ বিশ্বাস অথবা পট শিল্পী নিখিল চন্দ্র দাস এরা শুধু নড়াইল জেলার নয়, দেশের সম্পদ। কিন্তু আমরা এই গুণী শিল্পীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি না।
এই প্রসঙ্গে শিল্পী এস এম সুলতানের একটি কথা না বলে পারছি না। আশির দশকে দেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিদেশ সফরে গিয়ে একটি আর্ট গ্যালারি পরিদর্শনের সময় এস এম সুলতানের আঁকা একটি ছবিতে নাম দেখে চিনতে না পেরে দেশে ফিরে সুলতানকে আবিষ্কার করেছিলেন নড়াইল থেকে। দেশবাসী চেনার আগে তাকে চিনেছিল বিশ্ববাসী। সুলতান মানুষকে ভালোবাসতেন। আপন করে নিতেন তাদের। কিন্তু আমরা কি তার জীবদ্দশায় তার যথাযথ মুল্যায়ন করতে পেরেছি? কেন তাকে তবে প্রকৃতির সঙ্গে ঝগড়া করে কাছে জবাব চাইতে হয়েছিল সেদিন রূপগঞ্জের, নিশিনাথতলার মন্দিরের পাশে মাটির কাছে। ওইদিন খুব রাগান্বিত হয়ে মাটিতে কয়েকটি জোরে পা দিয়ে আঘাত করে বলে ওঠেন ‘মানুষ আমার আপন হয় না; তোরা কেন এত আমার আপন হোস‘। কথাগুলো আমাকে জানিয়েছিলেন ওই সময়ে তার সঙ্গে থাকা শিষ্য নিখিল চন্দ্র দাস। সুলতান প্রকৃতিকে আকড়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা নিতেন। একদিন তিনি তার শিষ্য নিখিল চন্দ্রকে নিয়ে নড়াইল জমিদার বাড়ির আঙিনায় গুল্ম তরুলতাকে দেখে বলে ওঠেন, ‘তরুলতা তুমি এত সুন্দর! কি সুন্দর তোমার রং। হয়তো মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা না পেয়ে প্রকৃতিকে তিনি আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন।
সুলতান দেশকে ভালোবাসতেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। পঞ্চাশের দশকে যখন তিনি ইউরোপ-আমেরিকা চষে বেড়িয়েছেন, ইচ্ছা করলেই তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন, কিন্তু সেটা তিনি না করে নড়াইলে ফিরে চাচুড়ি-পুরুলিয়াতে ‘নন্দন কানন’ আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার নিজের অনেক কথা থেকে দেশের প্রতি তার ভালোবাসা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একবার তার শিষ্য বিমানেশ বিশ্বাস ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমি থেকে আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত হলে ‘বাটা’ সু কোম্পানি তাকে ‘এথেন্সে’ চাকরি করবার সুযোগ দেয়। শিষ্য বিমানেশের মুখে এই কথা জানবার পর গুরু এস এম সুলতান তাকে বলেছিলেন, ‘সারাজীবন জুতার ছবি না একে দেশে যেয়ে খুলনা আর্ট কলেজে যোগ দাও, এতে করে সেখানে তোমার সন্তান তৈরি হবে’। এই কথা থেকেই বোঝা যায়, দেশের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধের কথা।
তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ একজন জাত শিল্পী। ১৯৭৫ সালের দিকে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে তার প্রথম চিত্রপ্রদর্শনীতে আগত সাংবাদিকরা যখন সেখানে উপস্থিত হয়ে হাতে থাকা কাগজে তথ্য-উপাত্তগুলো লিখে নিয়ে পত্রিকাতে খবর প্রকাশের আশ্বাস দিয়ে দ্রুত চলে যাবার জন্যে সুলতানের কাছে বিদায় নেবার কথা জানালেন। তখন অনেকটা অভিমানের সুরে তিনি বললেন, প্রায় ত্রিশ বছর ধরে আমি মানুষকে নিয়ে ভাবছি, আর দশ মিনিটেই তা লিখে ফেললেন আমি তো এমন সাংবাদিক চাইনি। আমি তো সাংবাদিকদের অনেক বড় মানুষ করতাম। ১০ আগস্ট, বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জন্মদিন। আমরা তাকে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, জাবি
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন