বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল প্রীতি দিয়েই মানুষের মন জয় করা
দীপক চৌধুরী : পাকিস্তান সব সময়ই বিদ্বেষ ও বৈরিতা সৃষ্টি করেছে এই বাংলার মানুষের ওপর। পাকিস্তানের মনে তাদের বিপরীত দেশ ভারত, মুসলমানের বিপরীত জাতি হিন্দু, মুসলমানদের ভাষা উর্দু আর হিন্দি ও বাংলা হলো হিন্দুর ভাষা, রবীন্দ্র নাথ হিন্দু কবি। এভাবে পাকিস্তান-ভারত, হিন্দু-মুসলমান, উর্দু-বাংলা, রবীন্দ্র -নজরুল বৈপরীত্যের ধারণার মধ্যে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গী সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানের হীনম্মন্য মনোভাবের প্রকাশও ঘটতোÑ যা বাংলার মানুষের কাছে ঘৃণার বিষয় ছিল। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গিও চিন্তা-চেতনা ছিল বাংলার মানুষের অধিকার নিয়ে।
আমরা জানি, মানুষের নানান আবেগের মধ্যে ধর্মভিত্তিক আবেগ সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং একই কারণে সহজেই তা অন্ধ শক্তিতে রূপ নিতে পারে। ১৯৭১ এর সেই ২৫ শে মার্চের কালরাত্রি এরই চরিত্র বহন করে। এ কারণেই এ ভূখ- ও জাতি গঠন, দেশ গঠন সম্ভব হতে পারে এ বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর। পিতার দেওয়া স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি, পিতার নির্দেশ, মানুষের ¯েœহ আর বঙ্গবন্ধুকে করেছিল অনন্য, অসাধারণ।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, মানুষকে ব্যবহার, ভালোবাসা, প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়। অত্যাচার, জুলুম, ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না। এই বিশ্বাস তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন। স্বপ্ন দেখতেন শেখ মুজিব। এ কারণেই তার ডাকে মানুষ সাড়া দিয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য চাই মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অবলম্বন করে বঙ্গবন্ধু এগিয়েছেন তার নির্ধারিত গন্তব্যে। দেশের মানুষ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও বৈরী শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে নামে। যার যা আছে, তা-ই নিয়ে চলে সে লড়াই এবং এটা কেবল শেখ মুজিবের ডাকে।
সুদূর অতীত থেকেই শেখ মুজিবের চোখে ছিলÑ মুক্তির স্বপ্ন, স্বাধীনতার স্বপ্ন। এ জন্য ক্ষেত্র দরকার। প্রয়োজন শক্তিশালী সংগঠন। সম্ভবত এ কারণেই Ñশাসকদের একটি পদক বা একটি ভালো চাকরির জন্য যেখানে অনেকে নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে, সেখানে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। সংগঠনকে সমৃদ্ধ করা ও সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ততার মাধ্যমে ১৯৫৪ সালের পরই ক্রমান্বয়ে শেখ মুজিব এই বাংলার রাজনীতির প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি যে এ রকমই হবেন, তাকে যে দাবিয়ে রাখা যাবে না এটা বোঝা যায় ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নিজের যে জীবনছবি তিনি এঁকেছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে, তা থেকেই। তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। ইতিহাস দখল করেননি। নিজেই ইতিহাস তৈরি করেছেন।
কৈশোর থেকেই তিনি মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, মানুষের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগের শিক্ষা নিয়েছেন এবং তার জন্যই পর্যায়ক্রমে তার উত্তরণ ঘটেছে শেখ সাহেব, মুজিব ভাই, লিডার থেকে হয়েছেন বঙ্গবন্ধু, হয়েছেন জাতির জনক। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হত তার জন্ম না হলে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব লিখেছেন:
‘গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছি। তিনি বলেছিলেন, দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। সম্পাদনা : সুমন ইসলাম