বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদে নেওয়া সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় প্রকাশ
মাহমুদুল আলম : বিভিন্ন উন্নত দেশে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে আমাদের দেশের সংসদ সদস্যদের দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা রায়ে এসব কথা বলেছেন হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গতকাল বৃহস্পতিবার এই রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে বলা হয়, এই সংশোধনী থাকলে বিচারপতিদের সংসদ সদস্যদের করুণা প্রার্থী হয়ে থাকতে হবে। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে বলেও বলা হয়েছে রায়ে।
১৬৫টি পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের আরেক বিচারপতি কাজী রেজাউল হক। তবে তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত ওই বেঞ্চের আরেক বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
এই মামলায় হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অর্থাৎ দুই বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন, এই রায় প্রকাশিত হয়েছে। বেঞ্চের অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের দেওয়া রায় এখন প্রকাশের অপেক্ষায়।
হাইকোর্টের এই বৃহত্তর বেঞ্চ সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে গত ৫ মে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের পর তা স্থগিত চেয়ে ৮ মে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি আবেদন করেছিল। এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার বলেন, প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা রায় অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর বিষয়টি শুনানির জন্য চেম্বার বিচারপতির আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, বলতে দ্বিধা নেই- ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইজীবীদের বক্তব্য থেকে রায়ে বলা হয়, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু ওইসব দেশের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আমাদের সংসদ সদস্যদের মেলানো ঠিক হবে না। ওইসব দেশের সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৯৫(২) সি অনুচ্ছেদে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে।
রায়ে অ্যামিচি কিউরিদের বক্তব্য থেকে বলা হয়, ড. কামাল হোসেন ও আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, কোনো সরকার এই আইন করেনি। এ ব্যপারে আমরাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একমত পোষণ করি। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে হেয় করা হয়েছে এবং নাজুক অবস্থায় ফেলা হয়েছে। আদালত এ মতের সঙ্গে একমত পোষণ করে একইসঙ্গে বলেন, বিচারপতি অপসারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি উত্তমপন্থা।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে দেওয়ার ফলে বিচার বিভাগের ওপর খ—গ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বিচারকদের ওপর যদি এই খ—গ ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তাহলে জনগণের মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবে। ন্যায়বিচার নিয়ে তখন জনগণের মনে সংশয় সৃষ্টি হবে। জনগণ যদি মনে করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই তাহলে বিচার বিভাগের অস্তিত্বই থাকে না।
যেহেতু ১৬তম সংশোধনী বিচার বিভাগের উপর আস্থা দুর্বল করেছে সে কারণে জনস্বার্থ ব্যাঘাত ঘটবে এবং জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কমনওয়েলথ ল্যাটিমার প্রিন্সিপাল ২০০৩ এর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এর উপর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা থাকাটাকেই সর্বোত্তম মনে করছেন আদালত। রায়ে বলা হয়, ১৬তম সংশোধনি সংবিধানের ৯৪(৪), ১৪৭(২) এবং ৭(খ) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সুতরাং এটা বাতিলযোগ্য ও সংবিধান পরিপন্থী।
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সম্পাদনা : সৈয়দ নূর-ই-আলম