নারী পুরুষ কতটা সমান?
এ দেশেও নারীদের ক্ষমতায়ন ও তাদের ধীরে ধীরে কিছু পর্যায়ে দারিদ্র মুক্তি হচ্ছে। নারীর মুক্তির জন্য শিক্ষারও বিস্তার ঘটছে। আজ শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ প্রায় সমান। জাতিসংঘের মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের ফলে বিভিন্ন পরিধিতে নারীর উন্নয়ন ঘটেছে। নারীর মুক্তির ক্ষেত্রে শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, মহিলা সংগঠন ও অন্যান্য বেসরকারি সংগঠনগুলোরও ধারাবাহিক অবদান আছে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পেশায় নারীরা অনেক এগিয়েছে। যদিও এখনও নারীর মুক্তি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
উনিশ শতকে এসে খ্রিস্টান মিশনারীদের উদ্যোগে যে নারীশিক্ষার সূচনা হয়েছিল, তারই অংশ হিসেবে অন্তঃপুরে নারীশিক্ষার গোড়াপত্তন হতে আমরা দেখি। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনুকূল পরিস্থিতিতে শুধু মিশনারীরা নয়, ব্রাহ্মসমাজ, শিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান, বিভিন্ন সমিতি-সংস্থা ও সরকার এই ধারার শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে।
১৮৮২ সালে ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার যখন শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হন, তখনকার অবস্থা ১৮৩৫ সালে যা ছিল তা বেশ ভিন্ন। এই সময়ে বাংলায় প্রাথমিক পর্যায়ে ১০১৫টি বালিকা বিদ্যালয় ছিল, যেগুলোর ছাত্রীসংখ্যা ৪১,৩৪৯। স্কুলগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ছিল বেসরকারি, তবে এগুলো সরকার থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য লাভ করত। ১৮৯৯ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে প্রাথমিক বালিকা স্কুলের সংখ্যা ৩০৯৪-এ পৌঁছায় এবং ছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১,০৭,৪০৩। ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকার ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের সংখ্যায় শিক্ষা বিভাগের ১৮৭১-৭২ সালের রিপোর্ট আলোচিত হয়। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতায় সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১১০টি এবং ১৪টি বালিকা বিদ্যালয় ছিল, যেগুলো সরকারি সাহায্য পায় না এবং উভয় স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা ছিল ৭৩২জন, এর মধ্যে মাত্র ৫৮জন ছিল মুসলিম ছাত্রী। এর চেয়েও অধিকতর করুণ চিত্র পাই ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ইডেন বালিকা বিদ্যালয়েÑ সেখানে মোট ছাত্রী সংখ্যা ১৫৩ জনের মধ্যে মুসলিম ছাত্রী সংখ্যা মাত্র ১ জন।
আর বর্তমানে সরকারি হিসাব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে ভর্তির হার শতকরা ৯১ ভাগ, যার মধ্যে মেয়ে শিশুরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে (যথাক্রমে ৯৪.৭ শতাংশ ও ৮৭.৮ শতাংশ)। গত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল থেকেও দেখা যায়, সব শিক্ষাবোর্ডেই মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছেলেদের তুলনায় ভালো কিংবা সমান ফলাফল করছে।
২০১২ ও ২০১৩ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় মেয়ে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছেলে পরীক্ষার্থীর চাইতে লক্ষাধিক বেশি ছিল। জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ২০১৩ সালে পুরুষ পরীক্ষার্থীর চাইতে লক্ষাধিক বেশি মেয়ে পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। দারিদ্র, পারিবারিক অনীহা, ধর্মীয় কুসংস্কার, ইভটিজিং, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার মতো বাধাসমূহ অতিক্রম করেই মেয়েরা এই সাফল্য অর্জন করেছে
শিক্ষার ফলে নারীর সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের বিকাশ তরান্বিত হচ্ছে, অন্যদিকে নারী তার নতুন জীবনবোধ নিয়ে অনেকক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি অর্জন করছে। বিংশ শতাব্দী নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এই শতাব্দীতে নারীরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। আর একবিংশ শতাব্দিতে এসে এই বাংলাদেশের নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছে, সেখানে শিক্ষা একটি প্রধানতম বাহন। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর এই অগ্রগতির ধারা রুদ্ধ করার জন্য চোরাগুপ্তা উদ্যোগ কোনো কোনো মহল থেকে এখনও আছে, তা আবার কখনও কখনও ভেদবুদ্ধিসহ বেশ উচ্চকিত হতে দেখি! তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন