বন্ধুত্ব কোনো সম্পর্কের নাম নয়
কিযী তাহ্নিন
এক কাঁকড়া সমুদ্রের পার ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রের বালিতে তার শরীরের ছাপে যে নকশার সৃষ্টি হচ্ছে, তা দেখে কাঁকড়া নিজেই মুগ্ধ হয়। মুগ্ধ কাঁকড়া হেঁটে বেড়ায়, নকশা সৃষ্টির আনন্দে বিভোর। কিন্তু মুগ্ধ সময়ের আয়ু বুঝি বেশি দীর্ঘ হয় না। কাঁকড়া পেছন ফিরে দেখে, নকশাগুলো মুছে দিয়েছে সমুদ্রের বে-হিসেবি ঢেউ। অভিমান হয় কাঁকড়ার।
সমুদ্রকে বলে, ‘কেন এমন করলে? তুমি কেন আমার আনন্দ নষ্ট করলে, তুমি না আমার বন্ধু?’
সমুদ্র বলে, ‘দূরে তাকিয়ে দেখ, জেলের দল আসছে তোমায় ধরে নিয়ে যেতে, তোমার পায়ের ছাপ খুঁজে খুঁজে, পায়ের ছাপগুলো তাই মুছে দিলাম, তোমায় যাতে খুঁজে না পায়, তুমি এবার নিশ্চিত থাকো বন্ধু।’
কাঁকড়া সমুদ্রের মাঝে আশ্রয় নেয়। মুগ্ধ সময় ফিরে আসে ঢেউয়ের টানে টানে। এটি একটি বন্ধুত্বের গল্প। গল্পটি শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল, এ মুগ্ধ সময়ের নাম হয়তো বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব বলে কোনো একটি সম্পর্ক নেই। বন্ধুত্ব একটি দর্শনের নাম। হয়তো জীবনকে দেখবার এক ধরন। যে দেখবার ধরনে, টিনের বাক্সে জমিয়ে রাখা পুরনো আঠাহীন স্মৃতিমাখা স্টিকারগুলো বন্ধু হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বন্ধু হয়ে ওঠা প্রথম মানুষটির নাম হয় মা। খুসখুসে কাশির খুনখুনে বুড়ি দাদির পান চিবানো টুকটুকে ঠোঁটের ফোঁকলা হাসি বন্ধু হয়ে ওঠে। বইয়ের পাতার সাতচল্লিশ নম্বর পেজের আট নম্বর লাইন হয়ে ওঠে বন্ধু। ক্লাসের সবচেয়ে বোকা মানুষটির সঙ্গে ক্লাস পালানো আড্ডার সুর বন্ধু হয়ে ওঠে। প্রিয় গন্ধ, প্রিয় মুখ, প্রিয় দৃষ্টি হয়ে ওঠে বন্ধু।
বন্ধুত্বের এমন কোনো সংজ্ঞা নেই যেÑ ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির শান্ত মীন রাশির মানুষের সঙ্গে ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির বৃষ রাশির কালো চুলের কোনো মানুষের বন্ধুত্ব হতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব নয়। সব সম্পর্কের একটিই ধারাÑ বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব আসলে একটি সময়ের ধরন। নিজেকে খুঁজে পাওয়া নিশ্চিত সময়ের নাম বন্ধুত্ব।
বন্ধু হলো টুপ করে খসে পড়া কাঠ গোলাপ, হাত বাড়িয়ে মুঠো ভরি পথ চলতে চলতে, ক্লান্তি মিলায় শ্রান্ত পথ চলায়। বৃষ্টির দিনে হঠাৎ রোদ্দুর, প্রখর রোদে হঠাত বৃষ্টি। বৃষ্টির মাঝে একটি ছাতা। স্তব্ধতায় সুরেলা সুর, তীব্র কোলাহলে স্তব্ধতার গান। বেঁচে থাকার আনন্দযাত্রার নাম বন্ধুত্বÑ এ জীবনে, আমরা সবাই তো কেউ কারও বন্ধু।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন