হোয়াই হেইট পলিটিক্স?
রাজনীতিবিদদের সীমাহীন দুর্বৃত্তায়নের কারণেই বর্তমান প্রজন্ম আজ রাজনীতিকে ঘৃণা করে। অধিকাংশ তরুণ তাদের ফেসবুক আইডির কন্ট্রাক্ট অ্যান্ড বেসিক ইনফোতে লিখে, ‘আই হেইট পলিটিক্স।’ প্রজন্মের এই রাজনীতিবিমুখতা একটি জাতির জন্য অশনি সংকেত। আধুনিক পৃথিবীতে মানুষমাত্রই রাজনৈতিক প্রাণী। ব্যক্তি থেকে শুরু করে বস্তুÑ সব কিছুই রাজনীতির অধীন।
সমাজ কোনদিকে যাবে তা নির্ধারণ করে রাজনীতি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তো রাজনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। এই দেশের জনগণ এখনও সেই শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি, যে শিক্ষা মানবিক, যে শিক্ষা তার মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধ জাগ্রত করবে। ফলে তারা ন্যায়-অন্যায়বোধ বোঝে না, মানবিকবোধে চালিত হয় না। এমন একটি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সমাজকে পরিচালনার জন্য রাজনীতির বিকল্প নেই। রাজনীতিবিদরাই তাদেরকে পথ দেখাবেন, সত্য ও ন্যায়বোধ শিক্ষা দেবেন।
কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তা কি হচ্ছে? হচ্ছে না। কিভাবে হবে? রাজনীতি তো এখন দুর্বৃত্তদের দখলে। বর্তমান প্রজন্ম রাজনীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন ছাত্ররাজনীতি নেই বললেই চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ নেই। বেশিরভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির নামে আছে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। ছাত্রলীগ যদি সুস্থধারার রাজনীতি চর্চা করত এই একক আধিপত্যে দোষের কিছু ছিল না। রাজনীতির নামে তারা ব্যস্ত গ্রুপিংয়ে, আধিপত্য বিস্তারে, মারামারি আর লুটপাটে। শুভবোধের বার্তা নিয়ে তারা যাচ্ছে না কোনো ছাত্রের কাছে, ছাত্রদের কাছে তারা তুলে ধরছে না ছাত্ররাজনীতির গুরুত্ব।
এর আগে ছাত্রদলও একই পথে হেঁটেছে। আর বাম সংগঠনগুলো তো তাদের ঐতিহ্য হারিয়ে বর্তমানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েই যাচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, রাখছে। আশির দশক থেকে ছাত্রদের রাজনীতিবিমুখীকরণ শুরু হয়েছে। সন্তানেরা রাজনীতিতে যুক্ত হলে তাদের অভিভাবকেরা সেটাকে বখে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া ভাবছে।
বহু স্কুল-কলেজে এখন লেখা থাকে ‘রাজনীতি ও ধূমপানমুক্ত’। রাজনীতির গুরুত্ব সম্পর্কে কত অজ্ঞ হলে রাজনীতিকে ধূমপানের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। ছাত্ররাজনীতির এই নিষ্ক্রিয়তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বর্তমান প্রজন্মের ওপর। ছাত্ররা সুস্থধারার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলে তারা ব্যস্ত থাকত সমাজসেবামূলক এবং সংগঠনকেন্দ্রিক যাবতীয় ইতিবাচক কর্মকা-ে। যেমন খেলাধুলা, বিনোদন আর বই পাঠ। দুই দশক আগেও ছাত্রসংগঠনগুলো পাড়ায় পাড়ায় নাটকের দল, গানের দল, সাংস্কৃতিক দল গড়ে তুলত।
এই যূথবদ্ধ সাংস্কৃতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের মানস গঠিত হতো, তারা খুব সহজেই সমাজের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারত। সেসব তৎপরতা নেই বলে কোমলমতি ছাত্ররা এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই তারা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে শুরু করেছে। তার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে সে দোদুল্যমান। কিন্তু তার রক্তের মধ্যে তো রাজনীতি। তাই সে নাম লেখাতে শুরু করেছে জঙ্গিদলে। এর মধ্য দিয়ে সে নিজের রাজনৈতিক আইডেন্টিটি খুঁজে পেতে চাচ্ছে। এটা যে ভুল পথ তা বুঝিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই।
এখনও সময় আছে, সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতিকে সক্রিয় করার। পড়ালেখার পাশাপাশি ছাত্ররা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হবে, সংগঠনকেন্দ্রিক যাবতীয় কর্মকা-ে সক্রিয় থাকবে। ছাত্ররা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলে তাদের মাথায় জঙ্গিবাদের ভূত সওয়ার হতে পারবে না, রাজনীতিই তাদের নানা ইতিবাচক কর্মকা-ে ব্যস্ত করে রাখবে। পরিচালিত করবে দেশপ্রেমের দিকে, শুভবোধের দিকে।
প্রজন্মকে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও শুভবোধের দিকে পরিচালনার জন্য ছাত্ররাজনীতির বিকল্প নেই। ছাত্রদের শেখাতে হবে এ দেশের ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্য। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে মূর্খরা আসবে রাজনীতি করতে। কারণ শূন্যস্থান কখনও শূন্য থাকে না, কোনো না কোনোভাবে ভরাট হয়ে যায়। রাজনীতির এই শূন্যস্থানটা দখল করে নেবে দুর্বৃত্তরা, অতীতে যেভাবে নিয়েছে। তারা লুটপাট চালিয়ে টাকার পাহাড় গড়তে থাকবে, আর আমাদের প্রজন্ম আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের শিকার হয়ে নাম লেখাতে থাকবে জঙ্গিদলে।
অতএব দুর্বৃত্তদের হাত থেকে ছাত্ররাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে এখনই। ইতিবাচক রাজনীতির প্রতি ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন