সন্তানদের আমরা কি হতে দিতে চাই?
অজয় দাশগুপ্ত
মফস্বলের এক স্কুলের একটি ছাত্র তার খসড়া খাতায় আঁকি-বুকি করতে গিয়ে চমৎকার একটি নারীর ছবি এঁকে ফেলেছিল। না, সেখানে কোনো কথিত অশ্লীলতার চিহ্ন ছিল না। পায়ের গোড়ালিতে নূপুর আর নাকে নাকছাবি। স্নান শেষে উঠে আসা শাশ্বত কোনো জননী বা মেয়ের ছবি। ছেলেটি তা বুঝলেও মাস্টার মানেননি। মাস্টারের মনে আগের সেই ভালোবাসা বা অনুভূতি নেই। তার বয়স বেড়েছে। একসময় তারুণ্যে এই ভদ্রলোক বেশ কয়েকটা প্রেমও করেছিলেন। তখন তার উড়ন্ত যৌবন। চিঠি লেখা পুকুরপাড়ে দেখা করা কিছুই বাদ পড়ত না। যথারীতি প্রেমের পর সামাজিক বিয়ে। জীবনে যেসব কিছু হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা পূর্ণ হয়নি। ঘুরতে ঘুরতে মাস্টারিতে এসে পড়া। এককালে এই ইনি লুকিয়ে লাল বই পড়তেন। সাম্যবাদের স্বপ্ন আর বিপ্লবের জন্য বাড়ি ছেড়ে পালাতেও চেয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। মধ্যবিত্ত পরিবারের চাপ আর মায়ায় সেটাও করে উঠতে পারেননি। যখন মাস্টারি নিলেন তখনও ভাবতেন সমাজ বদলে দেবেন। এমন সব ছাত্র তৈরি করবেন যারা এইদেশ ও সমাজকে আলোয় ভরে তুলবে। সেই মাস্টার মশাইয়ের আজ অন্য চেহারা। বয়সের ফাঁক গলে তার মগজে ঢুকেছে স্বর্গ নরকের ভূত। কোনটা পাপ, কোনটা পূণ্য সে চিন্তায় এখন সময় কাটে তার। বইয়ের ধরন গেছে বদলে। নিজে জীবনের অনেককিছু তাড়িয়ে ভোগ করার পর এখন বাচ্চাদের বেলায় কঠিন। তাদের একপা এধার ওধার দেখলে মেজাজ খিচড়ে যায় তার। এই ছেলেটিকে তিনি অশ্লীলতার দায়ে এমনকি ছবি আঁকার দায়ে এমন শাস্তি দিতে চাইলেন যাতে তার আর পড়াশোনাই না হয়।
সেটা অবশ্য সম্ভব হয়নি। কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই ব্যক্তিগত? কোনো মাস্টারের কি এমন ভাবনা থাকা উচিত? আমাদের সময় আমরা দেখেছি, টিচাররা বাড়তি কাজ বা সৃজনশীলতার জন্য প্রেরণা দিতেন। স্কুলে স্কুলে গান-বাজনা, আঁকার প্রতিযোগিতা হতো। সে কারণেই কিন্তু এদেশের সংস্কৃতি জীবন নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পেরেছি। আজকাল এসব বিষয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। বড় জোর ক্রিকেট বা ফুটবল। একটি ছেলে কোটি কোটি প্রতিভার ভিতর এগারো জনে চান্স পাবে না জেনেও এই অত্যাচারের শিকার।
অন্যদিকে, সৃজন মানুষের মগজের ঔষধ। তাকে নানা প্ররোচণা থেকে দূরে রাখে। এমনিতেই এখন শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা ঘরের বাইরে পা রাখে না। তাদের চোখ, হাত, মগজের কোনো ব্যায়াম নেই। বিশ্রাম নেই। সেখানে তাদের গান, আঁকা, লেখার মতো কাজে বিরত রাখা মানেই তো অন্যকিছু বা উত্তেজনার দিকে ঝুঁকে দেওয়ার কাজটি করা।
এমন চললে কি জঙ্গিবাদ দমন হবে? বাচ্চাদের আমরা কবি হতে দেব না। গায়ক-গায়িকা হতে দেব না। ছবি আঁকতে দেব না। তবে তারা কি হবে? সারা দিনমান এক কথা, এক ধ্যান, এক দিকে ধাবিত করলে তারা এমন কিছু করতে উধাও হবে যে, মা-বাবা, সরকার, পুলিশ সবাই খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
তখন বেদনা বা কান্নার নাম হবে মায়াকান্না। সেটাই কি করছি আমরা?
লেখক : সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন