শিক্ষক বিপথগামী, কোন পথে যাবে শিক্ষার্থী?
ডা. জাকির হোসেন
পেরিয়ে এসেছি আমার সুখের ছাত্রজীবন। পিছনের দিকে ফিরে তাকালে শুধু কিছু গুরুজনের মহিমাময় কীর্তি নিজের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভুলতে পারি না নিজের ছাত্রজীবন, ভুলতে পারি না জীবনের মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষকের ভূমিকার কথা। সমাজ গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজকের ছাত্র আগামী দিনের কর্ণধার, জাতির পথপ্রদর্শক। জীবনে মূল্যবোধ গড়ার আদর্শ কারিগর হলেন শিক্ষক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মানবিকতার বিকাশ উৎপাদনের বৃহৎ কারখানা।
একটা সময় ছিল যখন দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধের পরীক্ষা দিতে হতো। একমাত্র আদর্শ শিক্ষকই পারেন শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিকাশ ঘটাতে। একজন গুণী শিক্ষক শুধু যে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায় ব্রতী করে তোলেন তা নয়, সমানভাবে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনে ব্রতী হনÑ এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অতীত ঐতিহ্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, তৎকালীন সময়ে একজন শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থীর জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে সর্বপ্রকার মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া।
শিক্ষা মানুষের মনের দরজাকে খুলে দেয়। তার মধ্যে বিচারিক ক্ষমতার উদয় ঘটায়। তার এই অর্জিত জ্ঞান দিয়ে সবকিছুর ভালো-মন্দ বিচার ও বিশ্লেষণ করতে শেখায়। মূল্যবোধের কারণেই মানুষ বিচার করতে শিখে। মানুষের মতো আচরণ করতে শিখে। মূল্যবোধ না থাকলে মানুষ তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা পশুত্বকে অমানবীয় আত্মাকে বিসর্জন দিতে পারে না। একজন শিক্ষকই শিক্ষার্থীকে যেমন পারে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে, তেমনি পারে তাকে মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে। একজন শিক্ষকের মহৎ ভূমিকাই সমাজ করতে পারে আলোকিত ও উদ্ভাসিত। অনেকগুলো কারণের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলোÑ শিক্ষদের পথভ্রষ্টতা। আজকাল পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যায়, কোচিং ব্যবসা নির্ভর হয়ে পড়েছে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা। প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মেয়ে শিক্ষার্থীরা। আর ভয়াবহ যৌন নিগ্রহের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষদের উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কোমলমতি তরুণদের রাজনীতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের অতিমাত্রায় দলাদলি, গ্রুপিং-লবিং, কোন্দল, প্রকাশ্যে দলীয় রাজনীতিক চর্চা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করছে প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উপর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আজকে মূল্যবোধের চর্চার অভাবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোসহ সর্বত্র অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। একটি উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।
শিক্ষক হলেন এই প্রকৃত শিক্ষা প্রসারের প্রধান ত্রাণকর্তা। শিক্ষা চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর প্রাণে মূল্যবোধ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ কারিগর। সুদূর অতীত থেকে সমাজে শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয় এটি হলো ব্রত ও সাধনার বিষয়। শিক্ষক হলেন মূল্যবোধ সৃষ্টির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এই পেশার সফলতা ও স্বার্থকতার ওপর নির্ভর করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। তাই শিক্ষক পথভ্রষ্ট হলে শুধু শিক্ষার্থী পথভ্রষ্ট হবে না। পথভ্রষ্ট হবে আমাদের ভালোবাসার বাংলাদেশ।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন