রাষ্ট্রের উন্নয়ন উদ্ভাবন ভাবনায় গণমুখী পরিবর্তনে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে
মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের ঐক্যের অন্যতম চালিকা শক্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবোধের মধ্যে আন্তর্নিহিত শক্তিই সমগ্র জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছে, গণমানুষকে উদ্বেলিত করেছে। স্বতন্ত্র ভৌগোলিক সীমারেখায় জাতিসত্ত্বা বিকাশে এদেশের মানুষ সেই স্বকীয়তায় স্ব-অস্তিত্ব রক্ষায় সচেষ্ট। আবহমানকাল থেকে বাঙালির জাতিসত্ত্বা বিকাশের প্রতিটি পরতে লক্ষ্য করা যায়, বাহিরের চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছুই সে গ্রহণ করেনি। নিজস্ব সত্ত্বা রক্ষায় শুধু প্রতিবাদই করেনি বরং রুখে দাঁড়িয়েছে, এমনকি জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেনি। এই মাথানত না করার পেছনে নিজস্ব স্বকীয়তাই তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
পাকিস্তান ঔপনিবেশ থেকে রক্ত[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের জন্ম দিল এদেশের আমজনতা, সেই রাষ্ট্রই অনেক ক্ষেত্রে জনগণের নিকট অপরিচিত মনে হয়েছে। পুঁজিপতিদের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির জন্য যে মানুষগুলো ত্যাগ সাধন করেছিল, জীবন দিয়েছিল, সেই রাষ্ট্রযন্ত্র ক্রমেই পুঁজিপতিদের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। সঙ্গত কারণে মুক্তিকামী মানুষগুলো মুক্তির সারথীতে রাষ্ট্রকে সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারেনি। এই না পারার কারণে সে মুক্তির জন্য ইহ জাগতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চেয়ে পরকালের চেতনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। অধিকাংশেই ভরসা করছে উগ্র ধর্মীয় আচারবোধের ওপর। যেটির সুযোগ নিচ্ছে উগ্র ধর্মীয় ব্যক্তিরা। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রবল আকাক্সক্ষা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। বাঙালির আবহমান বিশ্বাস অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ এখনও হুমকির মুখে। ব্যক্তি সমৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নৈতিক মূল্যবোধ ক্রমেই ক্ষয় হচ্ছে। এ অবস্থার উত্তরণের জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষা, চেতনা, মূল্যবোধকে ধারণ করতে হবে রাষ্ট্রকেই এবং সে মাফিক সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই।
গণমানুষের চিন্তা-চেতনা ও ভাবাবেগকে ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনার যে নীতি বা আদর্শ বঙ্গবন্ধু সূচনা করেছিলেন, সার্বিক মুক্তির জন্য আমাদের সেই পথে হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। উন্নত দেশ নির্মাণের অঙ্গীকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশজ চেতনাবোধ থেকে পিতার প্রদর্শিত পথে হাঁটার চেষ্টা করছে, যেটি দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য সুখকর। কিন্তু ঔপনিবেশিক মানসিকতাসম্পন্ন আমলাতন্ত্রের একটি অংশ জাতির এই চেতনা বা স্পিরিট এখনও ধারণ করতে পারছে না। সরকার প্রধান অনেক দেশপোযোগী চিন্তা-চেতনায় পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও অনেক ক্ষেত্রে সেখানে বাধ সাধে দেশপ্রেমহীন আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।
আর সে কারণেই স্বাধীনতার ৪৫টি বছর পরেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গণমানুষের কল্যাণ চেতনায় তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা বিকাশে কিছু মৌলিক পরিবর্তনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বঙ্গবন্ধু মহাপ্রয়াণের পর সবকিছু উল্টো পথে ধাবিত হয়েছে। দিক নির্দেশনাহীন বিভ্রান্ত জাতি এডহকইজমের পথে একই ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হয়েছে। সেই ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত করে জাতিকে নতুন পথে ধাবিত করা এখন শুধু সময়েরই দাবি। এছাড়া জাতির অগ্রগমনের আর কোনো বিকল্প নেই। সেই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ভাবনায় মৌলিক পরিবর্তন সাধনে সরকারকে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছি।
১. রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক, পরিকল্পক ও দেশপ্রেমিক আমলাতন্ত্রকে কিছু বিষয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা ভাবতে হবে। বিশেষ করে মধ্যম ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনের উন্নয়ন দর্শন নির্ধারণে কাজ ও কাজের লোককে সম্মান করা রাষ্ট্রীয় নীতি বা দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, যা অতীতে করা হয়নি।
অথচ কাজ ও কাজের মানুষ ব্যতীত কোনো উন্নয়ন উৎপাদন সম্ভব নয়। মনুপ্রবর্তিত শ্রেণি বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য, নমশুদ্ধের ধারাবাহিকতায় সৈয়দ, খন্দকার, খান, গৃহস্থ এবং ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর শ্রেণি বিভক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কাজ ও কাজের মানুষকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। দুইশত বছরের এই অচলায়তন ভেঙে শেখ হাসিনা প্রথম যাত্রার সূচনা করেছে। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কাজ ও কাজের লোককে অবজ্ঞা, অবহেলা ও ঘৃণা করে না। উন্নয়ন, উৎপাদন, অর্থনৈতিক মুক্তি, সমৃদ্ধি কোনোটিই নিরলস কাজ ব্যতীত অসম্ভব। বিশে^র সকল দেশ হোয়াইট কালারিজমের পরিবর্তে কাজ ও কাজের মানুষেরই সর্বোচ্চ সম্মানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই কাজ বা কাজের মানুষ তথা শ্রম ও শ্রমজীবীকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে।
২. ২০২১ সালে মধ্যম ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমানে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়টি। এসব লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূলে দক্ষ মানবসম্পদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এই গুরুত্ব অনুধাবনে সরকার ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ২০ ভাগে এবং ২০৩০ সালে ৫০ ভাগে উন্নীতকরণের কর্মপরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। এরপরও সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার বিষয়টিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য দক্ষ বাংলাদেশ নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। তাই দেশের সামগ্রিক কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অতিশীঘ্র কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন প্রয়োজন।
৩. সংবিধানে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার বাসস্থানের বিষয়টি দীর্ঘদিন এদেশে গুরুত্ব পায়নি। দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য পরিকল্পিত আবাসনের সংস্থানের জন্য ‘ন্যাশনাল হাউজিং অথরিটি’ গঠন করা হয়। গৃহায়ন নীতি প্রণয়নকালে আইডিইবি থেকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের কাজকে গ্রামীন গৃহায়ন ও নগর গৃহায়ন ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের কোনো আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নেই উদ্যোগী হয়নি। বরং নগর ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন করে গৃহায়ন অংশকে নিয়ে ‘গৃহায়ন মন্ত্রণালয়’ গঠন এবং হাউজিং কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত করে গ্রামীন জনপদের জন্য পরিকল্পিত সাশ্রয়ী বাড়ি-ঘর নির্মাণে জনগণকে সহায়তা করার বিকল্প নেই।
লেখক : সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি), সম্পাদক, কারিগর
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন