অন্যের আয়নায় নিজেকে দেখি
ফরহাদ মজহার
ধর্মের সঙ্গে ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কি হতে পারে তাকে পর্যালোচনার অধীনে আনার গুরুত্ব আমরা কখনই স্বীকার করিনি। পাশ্চাত্য যে অর্থে ‘রিলিজিয়ন’ বোঝে, আমরা সেভাবেই ‘ধর্ম’ কথাটা বুঝেছি। ইসলাম যখন ‘দ্বিন’ কথাটা বলে, সেটা যে খ্রিস্টিয় ‘রিলিজিয়ন’ কিংবা পাশ্চাত্যের খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাস দিয়ে বোঝা যায় না, এই অতি সাধারণ সত্য কথাটা আমল করিনি। সামন্তবাদ ও গির্জার হাতে কুক্ষিগত রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। প্রাচ্য ইউরোপীয় সামন্তবাদের ইতিহাস নয়। মন্দির, মসজিদ, মঠ বা আখড়ার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল না। কিন্তু আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মানদ- দিয়ে ধর্ম ও রাজনীতির ইউরোপীয় বিভাজনকেই আমরা শ্বাশ্বত ও সার্বজনীন মেনে নিয়েছি। ধর্মকে পাশ্চাত্যের অনুকরণে প্রাইভেট ব্যাপার দাবি করে সংস্কৃতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মকে নির্বাসিত করেছি। ‘দ্বিন’ ধারণার মধ্যে মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার ধারণা কিভাবে নিহিত তাকে পর্যালোচনার কোনো দায় বোধ করিনি। কথাটাকে আদৌ আমলে নিইনি। কারণ ইতোমধ্যে আমরা ‘রিলিজিয়ন’ই শুধু বুঝি, আর কিছু বুঝবার ক্ষমতা হারিয়েছি। মানুষের জীবন যে নিছকই জীবের জীবন নয়, তার মধ্যে কিছু দিব্যগুণাবলি আছে যার চর্চার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও সামাজিক বিধি-বিধান দরকার ‘দ্বিন’ ধারণার মধ্যে নিহিত এই ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ আহ্বান আমাদের কানে এসে পৌঁছায়নি। ‘দ্বিন’ শব্দটি আরবি বলে তাকে ধর্মতত্ত্বের বাইরে পর্যালোচনার করবার হিম্মত আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
আমরা ইউরোপীয় হয়েছি। আধুনিক। কে ইসলামের পক্ষে আর কে বিপক্ষে সেটা এখন কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছেÑ ইউরোপীয় মন নিয়েই আমরা ধর্ম বুঝি। ইউরোপীয় মনমানসিকতা নিয়েই ইসলাম পড়ি, ইসলাম বুঝি। ইসলামপন্থি হোক কিংবা বিপরীতে হোক ধর্ম নিরপেক্ষ জাতিবাদীÑ উভয়ের জগত একটাই। ভাববার কোনো কারণ নেই যে আমরা নিজেকে ইসলামপন্থি দাবি করি বলে যতই ইউরোপীয় অর্থে ‘র্যাডিক্যাল’ হই না কেনÑ ইউরোপীয় চিন্তার পরিম-লের বাইরে বাস করবার শক্তি আমরা এখনও অর্জন করিনি। সেটা দীর্ঘ অধ্যবসায়, প্রজ্ঞার চর্চা কিংবা ইসলামি অর্থে নিজের সঙ্গে নিজের ‘জিহাদ’ বা নিজেকে রূপান্তরের প্রশ্ন। যে দুটি পক্ষে আমরা বিভক্ত হয়ে পড়ছি সেই দুটি পক্ষই ইউরোপীয় মনমানসিকতা ও চিন্তার জগত থেকে উৎক্ষিপ্ত। দুইপক্ষ পরস্পরের মধ্যে পরস্পরকে আবিষ্কার করে, নিজের ‘অপর’ দ্বারা তাদের নিজ নিজ আত্মপরিচয় ও বিরোধের চরিত্র নির্ণয় করে। ধর্মের প্রশ্ন মীমাংসা না করা কথাটাকে তাই হালকাভাবে নেবার উপায় নেই। নাফসানিয়াত থেকে রূহানুয়াতের অভিমুখে নিজেকে উত্তরণের লড়াইকে যতই স্রেফ ধর্মতত্ত্ব বলে নাকচ করি না কেন, মানবেতিহাসের এই ঐতিহাসিক কর্তব্যটুকু পালনের অভাব থেকেই যায়। এই উত্তরণের প্রশ্ন আসলে চিন্তার একটি বদ্ধ পরিম-ল, একটি যুগ, মানবেতিহাসের একটি পর্ব, একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে যাবার প্রশ্ন।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন