মেঘের চেয়ে সজল বজ্রের চেয়ে তীব্র জনক আমাদের
এক. আমরা তখন স্কুলের শেষ ধাপের ছাত্র। সকাল থেকে বলতে গেলে রাত থেকেই বিনিদ্র। কাল আমাদের শহরে আসবেন তিনি। আসবেন মানে যাবেন শহর দিয়ে। বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূকেন্দ্রের উদ্বোধন করবেন এদেশের শেষ রাজনৈতিক কবি। তখন কেউ মালা ফুল বা সম্মান কেনার কথা স্বপ্নেও ভাবত না। এদেশের কুলাঙ্গার জোর করে গদি দখলের রাজাদের মতো গুণে গুণে মালা গলায় নিয়ে বলত না টাকা দিলাম একশটার পেলাম নব্বইটা কেন? বাকিটার টাকা কোথায়? তখন মানুষ রাজাকে জানত আপন ভূবনের মনের রাজা। তাইতো রাত জেগে মালা গাঁথতো তারা। সে এক অজানা বাংলাদেশ। আজকের তরুণ-তরুণী বা শিশুরা জানে না মানুষ কেমন পাগলের মতো ছুটে আসত। যার যা আছে তা নিয়ে। কেউ তার বাগানের সবজি, কেউ বারান্দায় ফোটা ফুলে গাঁথা মালা কেউবা আপন হাতে বানানো পিঠা নিয়ে। তিনি পাবেন না খাবেন না দেখবেন তা বড় কথা নয় তাকে একটু দেখতে পেলেই হলো। আমরা তখন খেলাঘর করতাম। সংগঠনের তো বটেই নিজের তাগিদেও ছুটে গিয়েছিলাম। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়ানো হাজার হাজার মানুষ। সকালের সূর্য তীব্র হচ্ছিল। তাপদহন বাতাসে আগুন তাও মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া তরুণ জেগে উঠে বলছে; চলে গেছে? কিন্তু বাতাসে তখন থেকেই বৈরি গন্ধের আনাগোনা। তাই নিরাপত্তা না মানা মানুষটিকেও মানতে হচ্ছিল ঘেরটোপ। অনেকগুলো গাড়ির ভিতরে যেটিতে তার থাকার কথা তিনি সেটিতে ছিলেন না। সেটি থেকে মাথা উঁচু করে সালাম নিলেন আজকের মন্ত্রী নাসিমের পিতা মনসুর আলী সাহেব। আমরা ভাবলাম, তিনি কি তবে আসেননি? একটু পর আরেকটি সাধারণ সাদা গাড়ি থেকে অল্প সময়ের জন্য মানুষের সামনে এসে দাঁড়ালেন আমাদের নেতা আমাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। হাওয়ার চেয়েও তীব্র বেগে ছুটে আসা মানুষের ভীড়ে হাসিমুখে নেতার হাত নেড়ে ভালোবাসা বিলিয়ে আবারো চলে গেলেন নিরাপত্তার ভিতরে। পরে যখন তিনি চট্টগ্রাম কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানে সারি বেঁধে দাঁড়ানো ছাত্র জনতার অনুরোধে দুকথা বলতেই হয়েছিল তাকে। শরীর খারাপ, কণ্ঠের অসুখ তারপরও ছাড় পাননি। কি বলেছিলেন? আজকের নেতাদের মতো কোনো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি বা মনভোলানো কথা না। শুধু রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন; চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিতবাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস। ব্যস, ওইটুকুই। তার গাড়ির বহর হয়তো পৌঁছে গিয়েছিল সুদূর বেতবুনিয়া, তারপরও সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত ওই এলাকাটি ভেসে যাচ্ছিল জয় বাংলায়।
দুই. কয়েকমাস পর আমি তখন এসএসসির ফলাফলের দিন গুনছি। সকাল থেকেই আকাশের মুখভার। রেডিও নির্ভর বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আতঙ্ক আর ভয়। কেউ জানে না আসলে কি ঘটেছে। সন্ধ্যা না হওয়া অবদিবিবিসি ভয়েস অফ আমেরিকা না শোনা পর্যন্ত কেউ কিছু মানতে চাইছে না। কিন্তু বাতাসে তখন লাশের গন্ধ। বাসার সকলের চোখ এড়িয়ে গলির মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। আরেক অচেনা বিশ্বাসঘাতক বাংলাদেশ তখন দোরগোড়ায়। শুক্রবারের পবিত্রতা ভেঙে কিছু মানুষ কোলাকুলি করছিল জান্তব উল্লাসে। তাদের কেউ কেউ মিষ্টি বিতরণও করেছিল। তাদের কারও মতে, ফেরাউনের রাজত্ব নাকি শেষ হয়ে গেছে। সেদিন আবার দেখলাম, পুরনো আক্রোশে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল সাবিত্রী পাইচ হোটেলের ওপর। ভারতের দালালদের নেতাকে মারার আনন্দ নাকি পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ, তা না বুঝতেই আকাশে উড়ল হেলিকপ্টার। তার বিকট শব্দের আড়ালে চাপা পড়ে গেল জনগণের রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুশোক। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ভ্যাগাকাশে দেখলাম, সামরিক চান-তারার নতুন অপজাগরণ। আহা আজ যিনি মন্ত্রী, আজ যারা তার নামে ফেনা তুলছেন, তাদের বিলিকৃত লিফলেট আর সামরিক যানের ওপর নাচের পনেরই আগস্ট তুমিও কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
তিন. আজ বাংলাদেশের মেঘে মেঘে যত শোক তত ষড়যন্ত্র। আজ আবার এক নতুন কায়দায় দেশ ও জাতির জনকের কন্যাকে ঘায়েল করার প্রচেষ্টা। কান পাতা দায়। গুজবে গুজবে সয়লাব বাঙালির মনোজগত। আজ পনেরই আগস্ট নিয়ে চলছে শোক উৎসব। ব্যানার টানিয়ে শোকের শুভেচ্ছা জানায় কথিত নেতারা। শোককে শক্তিতে পরিণত করার জন্য মাঠে নামা বঙ্গবন্ধু পরিষদ বা সুশীল বুদ্ধিবৃত্তি উধাও। সুবিধাবাদ আর চাটুকারদের হাতে বন্দি শোক দিবসে যারা মাতম করে তাদের বুকের ভিতর গুলশানের জঙ্গিদের জন্য মায়া। তাদের কথা-কলমে আপাত বেদনার ফাঁকে ফাঁকে পাকিপ্রেম। পনেরই আগস্ট ঘরে একরকম বাইরে আরেক ধরনের। এই কি তার প্রাপ্য? এজন্যে কি তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে এদেশ স্বাধীন করেছিলেন? আজ যারা সবুজ পাসপোর্ট আর নাগরিকত্বের পালে হাওয়া লাগিয়ে ধনী সম্ভ্রান্ত অভিজাত ভোগী বা ব্যবসায়ী বা মিডিয়া মোঘল তারা কি একবারও ভাবেন কার নাম কৃতজ্ঞতা? কাকে বলে দেশপ্রেম?
চার. একদল এখনও রক্তমাখা কেকের লিপিস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে রাজনীতি করে। আরেক দলের সামনে আছে তাকে হেয় করে প্রতিশোধ নেবার লালসা। যারা তাকে পুঁজি করে তারাও কোলাহলে মত্ত। বাকি থাকল সাধারণ মানুষ। যারা শোকসভায় যায় না। কোথাও কিছু বলে না। কোনো নাটক, গান, কবিতা এমনকি হয়তো টিভিও দেখে না। তারা নীরবে স্মরণ করে। রাতের অন্ধকারে আকাশ হাওয়া মাটি জোসনা চাঁদের সঙ্গে মিশে যাওয়া তাদের ভালোবাসা পৌঁছে যায় দূর দিগন্তে। সেখানে দুবাহু পেতে থাকা বঙ্গবন্ধু তাদের ভালোবাসা বুকে নিয়ে বলেন; আমি আছি। আমার চোখের জল, আমার বুকের রক্তে আমি এদেশকে আগলে আছি। তোমরা নির্ভয়ে থাকো বাঙালি।
পাঁচ. এমন নেতা কি আর কোনোদিন জন্মাবে, যার বুকেই শুধু গুলি আর গুলি। এমন বুক পেতে নেওয়ার দেশে শোক কবে শক্তি হবে?
লেখক : সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন