বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি নাম শেখ মুজিবুর রহমান
প্রফেসর ড. মোঃ মাহ্বুবর রহমান
১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে শোকের ও কলঙ্কিত দিবস। ইতিহাসের এই কালো দিনে বাঙালি জাতির গৌবোজ্জ্বল অধ্যায়কে কলঙ্কিত করা হয়েছে। বিশ্বে বাঙালির একমাত্র স্বাধীন সার্বোভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের হায়েনাদের কবর কারাগার থেকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বধীন বাংলার জন্ম দিয়ে দেশে ফিরে আসলেও বিশ্বনন্দিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার, নিকট আত্মীয় ও সহযোগীসহ মোট আঠারো জন নিরপরাধ মানুষকে এ কলঙ্কিত দিবসে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে একাত্তরে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ নারীর ইজ্জত সম্ভ্রমের বিনিময়ে লব্ধ বাঙালির সকল অর্জনকে ধুলিস্যাৎ করা হয়েছে। আমাদের বহুল প্রতিক্ষীত ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি ধ্বংস করাই ছিল পরাজিত পাকিস্তানি হায়েনাদের এ দেশীয় দোসর এবং আন্তর্জাতিক কুচক্রীদের নীলনকশা অনুযায়ী সংঘটিত এ কাপুরোষিত হত্যাযজ্ঞ। শুধু তাই নয়, সেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি কুচক্র মহলটি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নিদর্শন এবং বর্তমান বাংলাদেশের সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও হত্যার নিমিত্তে আগস্ট মাসে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে মুছে ফেলাই যে তাদের লক্ষ্য ছিল, তার প্রমাণ ’৭৫ এর পনের ও ২০০৪ এর একুশে আগস্টের নীলনকশা। আগস্ট মাসে আমি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের অগ্রপথিক জননেত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্র রাতারাতি বা আকস্মিকভাবে প্রতিষ্ঠা হয়নি, এসব কিছুর পেছনে ছিল এক সুদীর্ঘ পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়ায় একটি জাতির আত্মবিকাশের গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ৬ দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পূর্ণতা এনে দেয়। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষিত নির্দেশনা ও আহ্বান এবং ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অনুযায়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে যে যেভাবে পেরেছে, যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝেঁপে পড়েছে।
দেশ স্বাধীনের এ রকম জনযুদ্ধের দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে খুব কমই পাওয়া যায়। সর্বস্তরের, সব পেশার ও সব ধর্মের জনগণের সম্পৃক্ততায় সুদীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বপ্নের স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় ঘটল দেশটির নামÑ বাংলাদেশ। বাঙালির এই মুক্তির সংগ্রামের মহানায়ক হচ্ছেÑ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সবকিছুর মূল প্রেরণা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। তাই বাংলাদেশ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গ্রোথিত এবং অবিচ্ছেদ্য।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তির পর নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকায় আসেন এবং ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। নিপীড়িত, নির্যাতিত, মুক্তিকামী, সংগ্রামী জনগণের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববাসী বরণ করেছিল। তিনি অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে উন্নয়নের স্রোতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে নেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু একের পর এক প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তার চিন্তা-চেতনা, প্রজ্ঞা, কর্ম ও দর্শন ছিল বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি উন্নত সুখী-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা হিসেবে বিশ্বের বুকে মর্যাদা ও সম্মানের আসনে দাঁড় করানো। গোটা বিশ্ববাসী যে মানুষটিকে কারিশমাটিক লিডার ভাবত, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য মঙ্গল দূত ভাবত, সেই দুর্লভ চরিত্রের মানুষটিকে এদেশের কিছু অকৃতজ্ঞ, স্বাধীনতাবিরোধী ও ক্ষমতালিপ্সু সেনার ছত্রছায়ায় রাষ্ট্রদ্রোহী সৈনিক বাংলাদেশের উন্নয়নের শুভ সূচনাতেই হত্যা করে গোটা বাঙালি জাতিকে কলুষিত করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাকে এদেশে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্র হলো বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারায় বাঙালি, বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য বিচ্যুত করার অন্যতম পদক্ষেপ ছিল বঙ্গবন্ধু ও তার সপরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বাংলাদেশ যাতে পুনরুজ্জীবিত হতে না পারে এবং বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার অশুভ লক্ষ্য ছিল সেই স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্র মহলটির। বাংলার সংবিধান ও ইতিহাস উল্টে দেওয়ার রাজনীতি শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করেন রাজনীতিতে এবং খোন্দকার মোশতাক কর্তৃক আরোপিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা আইন বহাল রাখেন যা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার বন্ধ রাখে। এ থেকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার বিষয়ে ধারণা করা যায়। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর জীবন, স্বাধীনতার ইতিহাস, দর্শন ও কর্ম নিয়ে ছিনিমিনি। বিভিন্ন অসত্য রটনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করার চেষ্টা চলে আসছে। এখন সময় এসেছে এসব দুস্কৃতি ও ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং আগামী প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার। যারা জাতির জনকের প্রতিকৃতি মুছে ফেলতে চায়, স্বাধীনতার শক্তি অস্বীকার করে যারা দেশকে বিকিয়ে দিতে চায়, ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই তাদেরকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর বিশ্বের অনেক পর্যবেক্ষক দেশটির অস্তিত্ব ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে টিকে থাকতে পারবে কিনা সকল ধরনের এমন সংশয় ও মন্তব্যকে এবং ষড়যন্ত্রের সকল বেড়াজাল মিথ্যা প্রমাণিত করেছে বঙ্গবন্ধুর বেঁচে যাওয়া সুযোগ্য কন্যা ইস্পাত দৃঢ় সাহসী, সুকৌশলী, দুরদর্শী ও প্রজ্ঞাশীল রাষ্ট্রনায়ক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর দৃশ্যমান হত্যাকারীদের বিচার করেছেন এবং অনেকের ফাঁসির রায় কার্যকর করেছেন। অনেকাংশে বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। তিনি বাঙালি জাতিকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অনুকরণে সময়ের উপযোগী কৌশলে ডিজিটাল বাংলাদেশের ‘রূপকল্প ২০২১’ ও ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং বাস্তবায়নে সকলকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর আত্মার আরাধনা ও তার প্রেরণার সুপ্ত শক্তির বদৌলতে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানি নাগপাশ থেকে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ এখন আর্থ-সামাজিক সব সূচকে পাকিস্তানসহ অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। সার্বিক মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪২তম। গত ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার সেখানে ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজাড় ৪৬৬ ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাত বছর আগে ছিল ৬.৩ শতাংশ, সেটি চলতি বছরে ৭.৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। যেখানে ১৯৯০ সালে দারিদ্রসীমা ছিল ৫৬ শতাংশ, ২০১৫ সালে তা নেমে এসেছে ২২.৪ শতাংশে। গত সাত বছরে শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও তার পরিকল্পিত পথে জননেত্রী শেখ হাসিনার সৎ ও সাহসী পদক্ষেপ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী পরাস্ত শক্তি জামায়াত-শিবির ও তাদের সরব মদদদাতা বিএনপির উন্নয়নে অগ্রসরমান স্বপ্নের সোনার বাংলাকে নানাধরনের অপকৌশলের মাধ্যমে ভূলুণ্ঠিত করতে গৃহীত নানা অপকৌশল ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সকলের উদ্বিগ্নের বিষয়। তার উপযুক্ত প্রমাণ হচ্ছে, ২০১৫ সালে আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ হত্যা এবং সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ হত্যা এবং অতি সম্প্রতি হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা চালিয়ে বিদেশি হত্যা, শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে বোমা বিস্ফোরণ করে মুসল্লি হত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জঘণ্য কর্মকা-। কিন্ত দেশের আপামর জনসাধারণ অত্যন্ত আশান্বিত যে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং সফলভাবে সকল ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেছে এবং জঙ্গিবাদ নির্মূলে বদ্ধপরিকর। সবকিছু কঠোর হস্তে দমন করা সম্ভব হয়েছে বলে দেশে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রা সকল ষড়যন্ত্রের মুখেও অব্যাহত রাখতে হলে দায়িত্বরত সকলকে সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একতাবদ্ধ থাকতে হবে। আগামী প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় গড়ে তুলতে পারলে সত্যিকার অর্থে ক্ষুধা, দারিদ্র, জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত, স্বনির্ভর অসাম্প্রদায়িক আধুনিক বাংলাদেশ উপহার দেওয়া সম্ভব। আর তাদের হাতেই বাস্তবায়িত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, আর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যম আয়ের এবং উন্নত একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ। পরিশেষে এটাই সত্যি, যে দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী গ্যালারিতে বসে নিজ দেশের খেলোয়াড়দের পতাকা নেড়ে উৎসাহিত করেন, চার ছক্কা পেটাতে দেখে কিশোরীর মতো উল্লাস করেন আর বিজয়ের পর আনন্দ অশ্রু বর্ষণ করেন, সে দেশে জঙ্গিবাদ বা কোনো অপশক্তিই মাথাচাড়া দিয়ে চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন