মৃত্যুহীন মুজিব…
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা ও তার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের যেসব ঐতিহাসিক অর্জন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার প্রতীক ও কেন্দ্রবিন্দু। এ বিষয়টিকে অস্বীকার করাটা একটি অন-ঐতিহাসিক প-শ্রম মাত্র। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত জিয়াউর রহমানের ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করতে হয়। তিনি ওই প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকার করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সবুজ সংকেত হিসেবে মেনে নিয়েছেন। ওই প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘তারপর এলো ১লা মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারা দেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা হলো। বিহারিরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে, এর থেকেই ব্যাপক গোলযোগের সূচনা হলো।’ ওই লেখার আরেকটি অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেনÑ ‘৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্তরূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না।’ জিয়াউর রহমানের এ লেখাটি বিএনপির ওয়েব সাইটে রয়েছে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে একটি ব্যক্তিগত হত্যাকা- হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, এইরকম দেখার কিংবা ভাবার অবকাশ নেই। একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যকে চরিতার্থ করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই লক্ষ্যটি ছিল দেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা থেকে কক্ষচ্যুত করে পরাজিত পাকিস্তানি ধারা ফিরিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীকী পুরুষ ও কেন্দ্রবিন্দুকে, তথা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ছাড়া এ ধরনের উল্টোমুখী রাজনৈতিক ডিগবাজি সংগঠিত করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা থেকে দেশকে সরিয়ে আনতে হলে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করাটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এবং ঠিক সেটিই করা হয়েছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বদলে ফেলে দেশকে সাম্প্রদায়িক, সামরিক-স্বৈরাচারী, পুঁজিবাদী-লুটপাটতান্ত্রিক ও সাম্্রাজ্যবাদ নির্ভরশীলতার পথে টেনে নামানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের গতিধারাকে বহুলাংশে উল্টে দিতে পারলেও, তার সবটুকু অর্জন নিঃশেষ করা যায়নি। তার কারণ, মুক্তিযুদ্ধ যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর কীর্তি তেমনি তা প্রধানত ছিল জনগণের নির্মাণ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হলেও জনগণকে হত্যা করা যায়নি। তাই, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা আজও জীবন্ত রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তা এখনও পূর্ণতা নিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা না পেলেও, তা নিরন্তর জাগ্রত রয়েছে কোটি মানুষের অন্তরে। একইভাবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও চিরঞ্জীব থাকবেন কোটি জনতার অন্তরে। তা এ কারণে, বঙ্গবন্ধু ও জনগণের মিলিত কীর্তি হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা ও তার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতা। জনতার মৃত্যু নেই, তাই মৃত্যু নেই বঙ্গবন্ধুরও।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন