বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা ও শিক্ষার অগ্রযাত্রা
আরিফুর সবুজ
জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে পৌঁছানোর মই হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের আচরণে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। মানুুষ সারাজীবনই শিক্ষা অর্র্জন করে থাকে এবং তা করে নানাভাবে, নানা উপায়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে। অনানুষ্ঠানিক, আনুষ্ঠানিক এবং উপানুষ্ঠানিক এই তিন শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে দিয়ে মানুষ জীবসত্তা থেকে মানবসত্তায় উত্তোরিত হয়। সক্রেটিস, এরিস্টেটল, প্লেটো, কনফুসিয়াস, জন ডিউই, জ্যাঁ জ্যাক রুশো, বার্র্গলে, জন ফ্রেডরিক হার্বাট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ যুগে যুগে বিভিন্ন দার্শনিক তাদের শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটিয়ে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক কাঠামোর দিকে ধাবিত করেছেন। দার্শনিকরা ভাববাদ, প্রয়োগবাদ, প্রকৃতিবাদ, বাস্তববাদ, অপরিহার্যবাদ, জড়বাদ, অস্তিত্ববাদ ইত্যাদি দর্শনের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার সরুপ উন্মোচন করে শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস পেয়েছেন। এইসব দার্শনিকের সঙ্গে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যুক্ত করা যায় অনায়াসেই।
শিক্ষা নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার পূর্র্বে তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষা পরিস্থিতি কেমন ছিল সেটা জানা দরকার। সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে রেডিও-টিভিতে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যে দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের সেসময়ের শিক্ষাব্যবস্থার চরম দুর্গতি উপলব্ধি করা যায়। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাবার পরিসংখ্যান ভয়াবহ সত্য। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা
আশি ভাগ অক্ষরজ্ঞানহীন। প্রতিবছর দশ লাখেরও অধিক লোক নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে। জাতির অর্ধেকের বেশি শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শতকরা মাত্র আঠারো জন বালক ও ছয় জন বালিকা প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে চার ভাগ সম্পদ শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কলেজ ও স্কুল, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে ব
ৃদ্ধি করতে হবে। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে।’
স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা যুগপৎভাবে শিক্ষার সকল স্তরে, সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সীমিত সম্পদের দেশে শিক্ষার বিস্তারে বঙ্গবন্ধু যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসিক এবং সেই দুঃসাহস কেবল বঙ্গবন্ধুরই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশের শতকরা ষাট ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। বিধ্বস্ত সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে একান্ন কোটি টাকা ব্যয় করার ঘোষণা দেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলার ঘোষণা দেওয়া হয়। তাছাড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্র্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান ও ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে চল্লিশ ভাগ কম দামে বই সরবরাহের ঘোষণাও করা হয়েছিল। বিশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য এবং শিক্ষাকে বেগবান করার জন্য নানামুখী কর্মকৌশল গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু।
শিক্ষার ওপর বঙ্গবন্ধু যে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে। ওই বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে তিন কোটি বাহাত্তর লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ করা হয়েছিল। গণশিক্ষা বিস্তারে তথা নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বরাদ্দ করেছিলেন আড়াই কোটি টাকা। তাছাড়া অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি, যা ছিল নারী শিক্ষা অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মাঝে বিনামূল্যে বই, খাতা, পেনসিল, দুধ, ছাতু, বিস্কুট বিতরণ করে শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা উন্নয়নের জন্য, সাধারণ মানুষের সন্তানেরা যেন শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য ছত্রিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লক্ষাধিক শিক্ষক বিদ্যালয়ের ভূমিসহ সকল সম্পদ সরকারিকরণ তথা জাতীয়করণ করেন। যেখানে সরকারি কোষাগারে তেমন কোনো অর্থ ছিল না, বিদেশি সাহায্য ছিল অপর্যাপ্ত, সেখানে এই জাতীয়করণের পদক্ষেপটি ছিল সত্যিই দুঃসাহসিক এবং তিনি তা বেশ সফলতার সঙ্গেই সম্পন্ন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু সবসময়ই গণমুখী শিক্ষাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গণমুখী শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়। এজন্যই ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়া সংবিধানের সতের নম্বর অনুচ্ছেদে তার নির্দেশনায় একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্র্ধারিত পর্যাপ্ত বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা পাঠদানের বিষয়টি আবির্ভুত করা হয়। তিনি বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন জনগণকে। তার দেখানো পথ ধরেই আজকে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় টেকনিক্যাল, পলিটেকনিক্যাল, মহিলা পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে পাশ করা দক্ষ মানবসম্পদ দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়েছিল, যার মূল উদেশ্যে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্ত-বুদ্ধিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যা মুক্তবুদ্ধির চর্চার পথকে সুগম করেছিল। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদাকে সভাপতি করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। সেই কমিটিকে বঙ্গবন্ধু দেশের শিক্ষার সামগ্রিক পরিস্থিতি জানা এবং শিক্ষা সম্পর্কে জনগণের মতামত জানার প্রতি গুরুত্বারোপের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী কমিশন জনগণের কাছ থেকে শিক্ষার বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো ও তাদের সুচিন্তিত মতামত আহ্বান করেন। সেই সবকিছু বিশ্লেষণ করে কমিশন ১৯৭৩ সালের ৮ জুন অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট এবং ১৯৭৪ সালের মে মাসে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করেন। এই রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের বেশির ভাগই প্রতিফলিত হয়েছিল। কমিশন শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, নারী শিক্ষার প্রসার, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ, শিক্ষার সকলক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যম প্রবর্তনসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্র্ণ সুপারিশ করে। এই সুপারিশগুলো করা হয়েছিল জাতীয় আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে। এই কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু সরকারও এই কমিশনের রিপোর্টকে সাদরে গ্রহণ করে। এবং তা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু পনের আগস্টে পাকিস্তানপন্থি নরখাদক নরকের কীটরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারকে হত্যা করলে অন্য সবকিছুর মতো শিক্ষা কার্যক্রমও আন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এরপরের দীর্ঘ একুশ বছর এদেশের শিক্ষা বঙ্গবন্ধুর জন্য ছিল অন্ধকারের যুগ, সাম্প্রদায়িকতা শেখানোর যুগ। সেই সময়কার সাম্প্রদায়িক শিক্ষা বিস্তারের জের আজ এখনও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। তবে আশার কথা, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার শিক্ষা দর্শনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আর তাই তার নেতৃত্বে আজকে বাংলাদেশে শিক্ষার সকল স্তরে, সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন