উন্নয়ন উদ্ভাবন ভাবনায় গণমুখী পরিবর্তন জরুরি
৪. সীমিত আয়তনের প্রিয় মাতৃভূমিতে কৃষি জমির পরিমাণ মাত্র ৮৮ লক্ষ হেক্টর। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অপরিকল্পিত আবাসন, নগরায়ন ও আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি গাণিতিক হারে কমছে। বর্তমানের ধারাবাহিকতায় কৃষি জমি নিঃশেষ হতে থাকলে আগামী ৫০/৬০ বছর পর আবাদী জমি অবশিষ্ট থাকবে না। এ প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন করে এর গ্রাম কার্যক্রম অংশকে নিয়ে ‘গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রণালয়’ গঠন করা প্রয়োজন। এ মন্ত্রণালয় গঠিত হলে দেশের ৮৭৩১৬টি গ্রামের গণমানুষের সঙ্গে সরকারের জনসম্পৃক্ততা, ঘনিষ্ঠতা ও আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
৫. হাজার নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদ-নদীর প্রবাহমান ধারা বজায় রাখা ছাড়া জীববৈচিত্র রক্ষা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও দেশের নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদি সরকারের পক্ষে মালিকানা/দায় দায়িত্ব কোনো প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়নি। সরকারের ঐকান্তিক প্রয়াসে দায় দায়িত্ব ও ক্ষমতাহীন নদী কমিশন গঠিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থাকলেও দেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় কোন ধরনের কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা নেই। অথচ নদ-নদীসহ প্রাকৃতিক জলাধারাসমূহ রক্ষা ও ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের সঠিক ব্যবহার ও তদারকির জন্য একটি সংস্থা থাকা প্রয়োজন। এ দিক বিবেচনায় নদী কমিশনকে পুনর্গঠন করে ‘জাতীয় পানি ও নদী কমিশন’ হিসেবে যথার্থ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করা যায়। এই রেগুলেটরি কমিশনে পানি সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করাসহ সংস্থাসমূহের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে।
৬. বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। সুজলা-সুফলা এদেশে যত ফল-ফলাদি ফলে, তা বিশে^র কোনো দেশেই ফলে না। যথাযথ সংরক্ষণে সুযোগ না থাকায় বিভিন্ন মৌসুমে পর্যাপ্ত কৃষি পণ্য ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ যথাযথ সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে এসব ফলমূল বছরব্যাপী জনগণ খাওয়ার সুযোগ পাবে, অন্যদিকে প্রসেসিং ফুড বহির্বিশে^ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব হবে। এপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় পুনর্গঠন ও বিভক্ত করে ‘ফুড প্রসেসিং মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
৭. ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধিদের চক্রান্ত প্রতিহত বা প্রতিরোধ করার জন্য জাতি প্রস্তুত ছিল না বিধায় আমরা অকালে জাতির পিতাকে হারিয়েছি এবং দেশ ও জাতি দিকভ্রান্ত হয়ে ৫০ বছরের জন্য পিছিয়ে পড়েছে। জাতির মেধা মনন থেকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতি মহান স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধিরা তা মেনে নিতে পারেনি। সে কারণেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্র এদেশকে অকার্যকর সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার হীনউদ্দেশ্যে একের পর এক সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চক্রান্ত চালাচ্ছে। এক মহাসংকটের মধ্য দিয়ে জাতি এগিয়ে যাচ্ছে। এই জাতীয় সংকট মোকাবিলায় আমাদেরকে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব যখনই এদেশের মানুষ কোনো সংকটে পড়েছে, তখন ’৫২তে ফিরে গেছে এবং গৌরবোদ্দীপ্ত একুশ থেকে জাতি নবপ্রেরণা ও উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে গেছে। শোষণ-বঞ্চনার পরাধীনতার জাল ছিন্ন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। বর্তমান মহাসংকট মোকাবিলায়ও সমগ্র জাতিকে ৭১ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে নবোদ্দীপনা ও চেতনায় এগিয়ে যেতে হবে।
সেই প্রেক্ষিতে সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, স্বাধীনতা বিরোধিদের অপতৎপরতা প্রতিহত করে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের ইউনিয়ন থেকে রাজধানী পর্যন্ত সকল পর্যায়ে ‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা যায়। এই কমিটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষকসহ সকল পেশাজীবীদের প্রতিনিধি, পুলিশ, আনসার, প্রশাসনের ইউএনও ডিসি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী সকল সংগঠনের প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
একথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের মতো দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে সমাজের উচ্চ শ্রেণির গুটিকয়েক মানুষই রাষ্ট্রের অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। আর সে কারণে রাষ্ট্রের যেকোনো গণমুখী পরিবর্তনে সবসময়ই প্রতিবন্ধকতার সুদৃঢ় দেয়াল তৈরি করে। নিজেদের ভোগ বিলাস তথা ব্যক্তিগত সম্পদের বিশাল প্রাচুর্য গড়ে তোলা, কোটি কোটি টাকার গাড়ি, বাড়ি, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদির সুযোগ অব্যাহত রেখে দেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতার ধুয়া তুলে জনকল্যাণমুখী সকল পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে দেয়।
লেখক : সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি), সম্পাদক, কারিগর
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন