আত্মঘাতী বাঙালি, আমাদের দায় ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ
বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে ইতিহাসের সৃষ্টি ও স্রষ্টা। শুধু বাঙালি ইতিহাস নয় বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি এমন একজন নেতা যিনি শুধু স্বপ্নদ্রষ্টা নন, স্বপ্নের রূপকারও বটে। আমরা বিশ্বাসঘাতক, আত্মঘাতী বাঙালি যিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকালের বিনিময়ে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন, আমরা তাকে হত্যা করেছি।
বঙ্গবন্ধু কেবল এই ভূখ-ের একজন অবিসংবাদিত নেতাই ছিলেন না; বরং সকল মেহনতি মানুষের হৃদয়ঙ্গমের মাধ্যমে ধাপে ধাপে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালিদের সব সুখ-দুঃখ ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে। তিনি গতানুগতিক কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না, যারা কেবল পরবর্তী নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে কেন্দ্র করে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপন লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তা অর্জনে স্থির ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই জন্যই ক্রমান্বয়ে তিনি হয়ে ওঠেন টঙ্গীপাড়ার খোকা থেকে রাষ্ট্রনায়ক, যিনি পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও বাঙালিদের স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের জন্য তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকালের দীর্ঘ ১৪ বছর অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে কাটান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- শুধুমাত্র কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা নয়; বরং তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা চেতনা, ঐক্য ও সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু রাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ভূলুণ্ঠিত করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল ওই ভাড়াটে খুনিদের মূল উদ্দেশ্য। তবে, এই ভাড়াটে খুনিদের পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি অনেক শক্তিশালী ষড়যন্ত্রকারী মহল।
সেজন্যই সমাজচিন্তক সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। সবদিকে বড় তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালোবাসায় এবং দুর্বলতায়। এবং সেই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে, ঈর্ষায় পীড়িত হয়ে ঈশিতের স্থান দখল করা যায় না। তাইতো এই ভূখ-ে মুজিবের স্থায়ী অবস্থান মধ্যগগনে এবং তার নাম শুনে শোষকের সিংহাসন কাঁপে।’
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তার সমগ্র জীবনের সাধনার আরাধ্য ধন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। তিনি এসে দেখেন মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানি হায়েনারা তার স্বপ্নের দেশকে শ্মশ্মানে পরিণত করে। কঠোর পরিশ্রম ও নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যখনই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনসহ উন্নয়নের রোডম্যাপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই আসে সেই ভয়াল কালরাত। জনক হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উন্নতি, প্রগতি, সমৃদ্ধি ও মর্যাদায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। এমনকি কাছাকাছি সময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ মালয়েশিয়াও বর্তমানে অনেক মানদ-ে আমাদের থেকে এগিয়ে, কারণ দীর্ঘ ২২ বছর তারা পেয়েছে তাদের রূপকার মাহাথির মোহাম্মদকে। আর আমরা পেয়ে হারিয়েছি আমাদের সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক জাতির জনককে। সারা পৃথিবীর সব সভ্য দেশের নেতৃত্ব ও জনগণ বারবার ধিক্কার জানিয়েছে এই ভয়াবহ হত্যাকা-ের জন্য। আমাদের চিনেছে এক অকৃতজ্ঞ ও কলঙ্কিত জাতি হিসেবে।
শুধুমাত্র দু’একটি ভাড়াটে খুনিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মাধ্যমে জনক হত্যার এই কলঙ্ক ঘোচবার নয়। তার আত্মার শান্তি ও কলঙ্কমোচনের জন্য প্রয়োজন তার আজীবনের লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলার বাস্তবায়ন ও গরিব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সর্বোপরি শোষণমুক্ত উন্নত এক বাংলাদেশ গঠন, যার স্বপ্ন তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন। তারই সুযোগ্য উত্তরাধিকারী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিচ্ছেন। যারা এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছে, আজকে তারাই বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে প্রশংসা করছে। এসবই সম্ভব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে। যিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি শুধু জাতির জনকের রক্তের নয়; আদর্শেরও শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার।
খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করতে পারলেও তার আদর্শ, চেতনা ও স্বপ্নের সলিল সমাধি করতে পারেনি। যার জন্য বাঙালিরা আজও যখনই কোনো দুর্দিনের মুখোমুখি হয়, তখনই অনুপ্রেরণা খোঁজে তার সাহসী, ত্যাগী ও সংগ্রামী জীবন থেকে। শরীর নশ্বর, কীর্তি অবিনশ্বর। তাইতো মুজিব মৃত হয়েও জীবিত কারণ মুজিব মানে লাল-সবুজের পতাকা, মুজিব মানে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গমাইলের ভূখ-, মুজিব মানে বিশ্ব মানচিত্রের বুকে আমার মানচিত্র, মুজিব মানে বাংলাদেশ। মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়েও অনেক শক্তিশালী। কিন্তু আমরা হারিয়ে বুঝেছি, আমরা কী হারিয়েছে? পৃথিবীর বুকে ক্ষণজন্মা এসব মানুষ ও নেতা প্রতি মুহূর্ত, দিন, বছর, দশক কিংবা শতাব্দিতে জন্মায় না । এরা কয়েক শতাব্দী পর পর আসে ধরাকে আলোকিত করতে কিংবা কোনো নির্যাতিত গোষ্ঠীর ত্রাণকর্তারূপে। যেমন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিতাড়নের জন্য এসেছেন মহাত্মা গান্ধী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বিলুপ্ত ও কালোদের অধিকারের জন্য আব্রাহাম লিংকন ও মার্টিন লুথার কিং এবং আফ্রিকায় কালোদের অধিকারের জন্য নেলসন ম্যান্ডেলা তেমনি বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ত্রাণকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে আর আমরা ফিরে পাব না। তাই শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের বাকি সদস্যদের রূহের মাহফেরাত কামনা করছি এবং সেই সঙ্গে দাবি জানাচ্ছি বিদেশে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর বাকি খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে অবিলম্বে রায় কার্যকরের। বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি ও খুনের দায় পরিশোধের জন্য সবার উচিত সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা শোষণমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে মনোবিবেশ করা। আজকের টগবগে তরুণরাই হবে স্বপ্ন পূরণের সেই সারথি।
লেখক : ফ্যাকাল্টি মেম্বার, অর্থনীতি বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন