আমি যেন একটা আজব চিড়িয়া!
স্বকৃত নোমান
সেলুন দোকানে আমি যে চেয়ারটিতে বসে চুল কাটাচ্ছিলাম তার কোণাকোণি পেছনের চেয়ারে বসে জনৈক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি তার গোঁফ ছাটাচ্ছিলেন। আমার সামনের আয়নায় তার মুখটি দেখা যাচ্ছিল। মুখে কদমছাট দাড়ি। মাথার চুল প্রায় সাদা। সেলুনের দরজা লাগোয়া বেঞ্চিতে বসে এক তরুণ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে বিড়ি ফুঁকছিল। তার উদ্দেশে বললেন লোকটি, ‘সিগারেট বাইরে গিয়া খাও, রোজা আছি, গন্ধ লাগতেছে।’ ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটির দিকে তাকাল তরুণ। চেহারায় যুগপৎ বিরক্তি ও বিস্ময়। তারপর বেরিয়ে গেল।
চুল কাটা শেষ হলে আমি বাইরে এসে দাঁড়াই। লোকটির তখনও শেষ হয়নি। আমি তার জন্য অপেক্ষা করি। প্রায় মিনিট দশেক পর তিনি বেরিয়ে এলেন। মেইনরোড ধরে দক্ষিণে হাঁটা ধরলেন। আমি তার পিছু পিছু হাঁটা ধরি। তিনি ঢুকে পড়লেন একটা গলিতে। আমি তখন পেছন থেকে ডাক দিই ‘চাচা’। তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। আমি বললাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি, চাচা?
: কী কথা? করেন।
: আপনি আজ রোজা রেখেছেন কেন? এখন তো রোজার দিন না।
তিনি দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিলেন একবার। বললেন, এমনি। রোজা রাখা সওয়াবের কাজ। রাখলাম আরকি।
আচ্ছা, আচ্ছা। বললাম আমি। তিনি আবার হাঁটা ধরলেন। চিরকালের সন্দেহবাদী আমিও তার পিছু পিছু হাঁটি। তার হাত দুটো পেছনে মোড়া। আমি পেছন থেকে আবার ডাক দিলাম ‘চাচা।’ তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। খানিক বিরক্তি ও সন্দেহের চোখে আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললাম, আপনি কেন রোজা রেখেছেন, জানার খুব ইচ্ছা আমার। বলবেন দয়া করে? কৃতজ্ঞ থাকব।
এবার তিনি আমার দিকে এমন চোখে তাকালেন, আমি যেন একটা আজব চিড়িয়া। আমি চেহারায় অনুনয়ের ভাব ফুটিয়ে তুলি। পেছনে মোড়া হাত দুটো ছেড়ে দিলেন তিনি। বললেন, জুলাই মাসের তিন তারিখ আমার মা মারা গেছিলেন, এই দিন আমি রোজা রাখি। আর প্রতিবছর আগস্টের পনের তারিখেও আমি রোজা রাখি।
আচ্ছা, আচ্ছা। বললাম আমি। তিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমি আর দাঁড়ালাম না। গলির পুব মাথায় এসে পেছন ফিরে তাকাই। লোকটি গলির পশ্চিম মাথায়। দক্ষিণে বাঁক নেবেন। বাতাসে উড়ছে তার সাদা পাঞ্জাবির পেছনটা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন