অন্যের আয়নায় দেখি নিজেকে
ফরহাদ মজহার
এই উপমহাদেশে আমরা ধর্মের প্রশ্ন মীমাংসা করতে পারিনি। ধর্ম পরিচয় আত্মপরিচয় নির্মাণের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক কর্তাসত্তার জন্ম দেয় তাকে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বিশেষণে অধীনে আনতে আমরা ক্রমাগত অস্বীকার করেছি। তাকে সাম্প্রদায়িক বলে নির্মূল করবার রাজনীতি করেছি। উলটো বাঙালি জাতিবাদী আত্মপরিচয়কে ঐতিহাসিকভাবে বিচার না করে তাকে চিরায়ত ও শাশ্বত দাবি করেছি। এর ফলে এখন যে রাজনৈতিক বিরোধ তৈরি হয়েছে তা ক্রমশ মীমাংসার অতীত হয়ে পড়ছে। এই অমীমাংসা আগামীতে আসন্ন বড়সড় রাজনৈতিক তুফানকে প্রলয়ংকরী করে তোলে কিনা সেটাই এখন বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই অমীমাংসিত বিষয় হয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাখবার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র তার সমাধান করতে পেরেছে বলে যে দাবি আমরা এতকাল শুনেছি, সাম্প্রতিককালে ইউরোপে ও আমেরিকায় পরিচয়কেন্দ্রিক রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে তার মৃত্যুঘণ্টা আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যে ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম আতংকের প্রাবল্য বৃদ্ধি সেই পুরনো থিসিসকেই সত্য প্রমাণ করছে যে পাশ্চাত্য নিজেকে ইসলামের ‘অপর’ হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত। এই ভাবনার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য তার খ্রিস্টিয় পরিচয়কেই প্রধান করে তুলছে, যেখানে ইসলাম বাইরের উপদ্রব। সাদা খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্য সভ্যতার দুষমন হিসেবেই ইসলামের পরিচিতি। ধর্মীয় পরিচয় রাজনীতির নির্ণায়ক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র সকল প্রকার আত্মপরিচয়ের বাইরে বা ঊর্ধ্বে যে নিরপেক্ষ ‘রাজনৈতিক পরিসর’ রক্ষা করবার দায় নিতে পারে বলে এতকাল দাবি করে এসেছে, সেখানে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বলা হয়, আধুনিক রাষ্ট্র ধর্ম কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নে উদাসীন বা নিরপেক্ষ। এই ঔদাসীন্য ও নিরপেক্ষতার মধ্যেই নাকি আধুনিক রাষ্ট্রের অগ্রসরতা ও শক্তি নিহিত। অথচ সাম্প্রতিককালে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে আধুনিক রাষ্ট্রের ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ সোনার তৈরি পিতলের কলসির মতো স্ববিরোধী বাগাড়ম্বরের অধিক কিছু নয়।
ভাষা, জাতিচেতনা, সভ্যতা/অসভ্যতার ধারণা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র নিরপেক্ষ নয়। ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের অমীমাংসা প্রকটভাবে ধরা পড়ে যখন রাষ্ট্রের নামে যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ বা জাতির পরিচয় রক্ষার জন্য প্রতিপক্ষকে হত্যা বৈধ বলে গণ্য করা হয়। আধুনিকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার কালে ধর্মের নামে যুদ্ধ বা ধর্মের কারণে হত্যাকে আমরা বৈধ মনে করি না, কিন্তু জাতি বা রাষ্ট্রের নামে হত্যা বৈধ গণ্য করি। কেন? তার কোনো সদুত্তর নেই। দরকার ছিল অপরকে হত্যা করবার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা, অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয়ের তরিকা আবিষ্কার করা। কিন্তু আধুনিকতা সেই ক্ষেত্রে আমাদের কোনো পথ দেখাতে পারে না। ধর্মের নামে হত্যার অধিকারকেই জাতিবাদ ও আধুনিকতার যুগে জাতি বা রাষ্ট্রের নামে হত্যার অধিকারে পর্যবসিত করেছে। মানুষ কি আদৌ অগ্রসর হয়েছে?
ধর্মের নামে হত্যা অন্যায়, এই যুক্তি মানলে প্রশ্ন তোলা যায় তাহলে রাষ্ট্রের নামে কিংবা জাতির নামে হত্যা বৈধ হবে কেন? হত্যার অধিকার চর্চার মধ্য দিয়ে ধর্ম, জাতি বা রাষ্ট্র যে সার্বভৌম ক্ষমতার চর্চা করে তাকে পর্যালোচনার অধীনে আনা একালে জরুরি। যদি ধর্মীয় পরিচয় থেকে মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর সমাজ ও রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি আমাদের কাছে আদরণীয় হয়, তাহলে জাতি বা রাষ্ট্রের পরিচয়ে পরিচিত হবার রাজনীতিকে আমরা অগ্রসর রাজনৈতিক চিন্তা বলব কেন? প্রশ্নগুলো সমস্যার গভীরতা বোঝার জন্য তুলছি। ঐতিহাসিক বিচারে দেখা যায়, আধুনিককালে ধর্ম পরিচয়ে পরিচিত হবার অধঃপতনের কথা বাদ দিলে আদতে ধর্ম মানুষকে গোষ্ঠী, নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির বন্ধন থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র জাতীয়তা ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের নামে মানুষকে খ-িত রাখে। জাতিতে জাতিতে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধের শর্ত তৈরি করে। বর্ণবাদকে টিকিয়ে রাখে, চিরতরে উৎখাত করতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি আচরণের মধ্য দিয়ে আমরা তা বুঝতে পারি।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন