বন্ধু, কী খবর বল?
ফেরদৌসি ডলি
স্যার আর্থার কোনান ডায়েল, অগাথা ক্রিস্টি, সত্যজিৎ রায়, ইয়ান ফ্লেমিং, কাজী আনোয়ার হোসেনÑ এই লেখকদের ডিটেকটিভ বই আমি প্রায় গো গ্রাসে গিলেছি। মাথার ভেতর সুযোগ পেলেই এ্যাডভেঞ্চার চলে আসে। আমার ইয়ারমেট মোমিক আর আমি একই সঙ্গে চাকরি করছি একটি অফিসে বেশ ক’বছর। স্টুডেন্ট লাইফের মতোই আমাদের সম্পর্ক। কাজ, গল্প, আড্ডা সবই প্রাণবন্ত। অনেকটা স্টুডেন্ট লাইফের আমেজ। মোমিক কবিতা লেখে। ওর বই বেরিয়েছে। আমার এক লাইন কবিতাও কোথাও বেরোয়নি। ব্যাপারটা আমার নিজের কাছে ভালো লাগে না। কেমন যেন একটু পেছনে মনে হয় নিজেকে। একদিন মোমিককে বললাম, আমাকে একটু কবিতা লেখার কায়দাটা শিখিয়ে দেবে? সে আনন্দিত চিত্তেই বলল ‘আচ্ছ’। তার কয়েকদিন পর আমাকে একটা বই দিল মাত্রা বিষয়ক (নামটা আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না)। পাশাপাশি এও বলল, তোমার ভেতরে যেকোনো সময় ভাব চলে আসবে, তখন তুমি সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলো। না হলে পরে আর ঠিকমতো মনে করতে পারবে না। আমি বই পড়ি আর সামনে কবিতা দেখলেই মাত্রা গুনি। বেশ বিছুদিন এভাবে চেষ্টা করেও ভাব আসেনি। আমি মোমিককে বললাম, না ভাই, আমার কবিতা লেখা হবে না। কোনো ভাবটাব আসছে না। তোমার বইটা ফেরত দেব (এই শর্তেই দিয়েছিলাম, যদিও এখন মনে করতে পারছি না ফেরত দিয়েছিলাম কিনা)। মনে মনে ঠিক করলাম, এই চেষ্টা বাদ দেব। আমি যা লিখছি তাই আমার জন্য ভালো (তখন আমি শুধু আমার সাবজেক্ট রিলেটেড বিষয় নিয়ে লিখতাম)। এর মধ্যে মোমিক চেম্বারে বসা শুরু করেছে আরেক বন্ধুর সঙ্গে। আমার কাছে গল্প করে যে, ওরা দুই বন্ধু ফিমেল পেশেন্টদের কাছ থেকে কোনো ভিজিট নেয় না। আমি হেসে বলি, ‘তাই নাকি? তাহলে তো ভালোই সৎকর্ম হচ্ছে। গরিবদের একটা জায়গা হলো সুচিকিৎসায়।’ ধনী-গরিব সব ফিমেল পেশেন্টকেই ফ্রি চিকিৎসা দেই আমরা, বলে মোমিক।
আমার বন্ধু নার্গিসের জ্বর। বলল, বিকেলে ডাক্তারের কাছে যাবে। বললাম, ‘ভালো ডাক্তার আছে ভিজিট লাগবে না। তবে আমার জন্য একটা বোরকা লাগবে।’ মানুষকে সারপ্রাইজ দিতে আমার খুব ভালো লাগে।
পরদিন নার্গিসকে নিয়ে মোমিকের চেম্বারে গেলাম। একটু আগে ভাগেই। ওর সহকারীকে বললাম, আমরা কি ডাক্তার সাহেবের রুমে বসতে পারি? উনার গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছি। আচ্ছা বলে সহকারী রুমের দরজা খুলে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘বসেন, স্যার এখনই আসবে।’ বসে আছি প্রায় আধা ঘণ্টা। বোরকার ভেতর ঘেমে অস্থির লাগছে। নার্গিসকে বললাম, ‘খেয়াল রাখ ডাক্তার আসে কিনা।’ আমি বোরকা খুলে চুল উঁচু করে ধরে বাতাস লাগাচ্ছি। ‘আমার বাড়ি থেকে কে এসেছে।’ বলতে বলতে মোমিক আমার সামনে এসে চোখ গোল গোল করে বলে, ‘ডলি তুমি?’ ‘ধ্যাত, সব প্ল্যান নষ্ট করেছ। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।‘ ‘আমি সত্যি সত্যি সারপ্রাইজ, তুমি এখানে আসবে আমি কখনও চিন্তাই করিনি।’ অতঃপর আইসক্রিম খেতে খেতে তিনজন গল্প করি এবং নার্গিসের প্রেসক্রিপশন নিই।
একদিন মোমিক আমাকে বলে তোমাকে একটা জিনিস দেব, নেবে? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। বিকেলে ও আমাকে একটা সাদা খাম দিল। বলল, বাসায় গিয়ে দেখ। ‘আচ্ছা’ বলে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। দুদিন পর আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘পড়েছ। কিছু বলবে?’ আমি হেসে বললাম, ‘অবশ্যই বলব। উঁচুমানের সাহিত্য হয়েছে। আমি যদি নিজের সম্পর্কে কিছু লিখি তাহলে এটা হবহু লিখব।’ মোমিক হেসে বলে, ‘তুমি তুমিই।’
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন