অন্যের আয়নায় দেখি নিজেকে
আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়ে হাসাহাসি করতে পারি। কিন্তু তিনি তামাশার বস্তু নন, তিনি রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী। তার জনপ্রিয়তার ভিত্তি ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ। তিনি তার খ্রিস্টিয় পরিচয়কে এর বিপরীতেই হাজির করেন। তিনি সবল মার্কিন জাতির সভ্যতা ও মহিমা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চান। ভালো কথা। তিনি আমেরিকায় কোনো মুসলমান আর ঢুকতে দিতে নারাজ। ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষের মধ্য দিয়ে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার খ্রিস্টিয় পরিচয়কেই সামনে নিয়ে এসেছেন। ইউরোপ-আমেরিকা সর্বত্রই আত্মপরিচয়ের রাজনীতি প্রবলভাবে ফিরে এসেছে।
দার্শনিক ব্রুনো লাতুর একটি সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু পরিচয় নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতি ভারতের একার সমস্যা নয়, তবে ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতি ভারতে যে প্রকট রূপ নিয়ে তথাকথিত আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্র ও পার্লামেন্টারি রাজনীতির পরিম-লে প্রকটভাবে হাজির, তার তুলনা একমাত্র ভারত নিজেই। বিজেপি ও তার দর্শন হিন্দুত্ববাদের মধ্য দিয়ে প্রকটভাবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত। তবে হিন্দুত্ববাদে বিজেপির একার একচেটিয়া নেই। এটা ভারতীয় রাজনীতির ধমনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, নইলে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না।
একটি তথাকথিত আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র কিভাবে ধর্ম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় আধুনিক ভারত তার দুর্দান্ত উদাহরণ। বাংলাদেশ সংকটাপন্ন, কিন্তু তুলনায় অনেক অগ্রসর। আধুনিক রাষ্ট্রের সংকট আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি, হয়তো এর জন্য আমাদের অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। কিন্তু সমস্যাকে খোলা মনে চিহ্নিত করতে পারলে উপমহাদেশকে পথ দেখাবার চাবিকাঠি আমরা পেয়ে যেতে পারি। ভারতের নজির থেকে আমরা বুঝতে পারি আধুনিক ধর্ম, নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও রাজনীতির ধর্মীয় বা ‘মৌলবাদী’ রূপান্তর একালের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ঘটনা।
তবে ব্রুনো লাতুরের জিজ্ঞাসা অন্যত্র, যা আমাকে ভাবিয়েছে। হিন্দু কখনই পাশ্চাত্য অর্থে ‘রিলিজিয়ন’ ছিল না। যদিও খ্রিস্টিয় ধর্মকে ধর্মের সার্বজনীন রূপ গণ্য করে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ধর্মকে আমরা বুঝে থাকি। অর্থাৎ খ্রিস্ট ধর্মের চরিত্র অনুযায়ী আমরা অন্য সকল ধর্মের চরিত্র বিচার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। লাতুর বলছেন, এটা বেশ অবাক কা- এহেন ‘হিন্দু’ ব্যাপারটা কিভাবে ইউরোপীয় রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের অংশ হয়ে গেল? যা কোনো কালে ধর্ম ছিল না তা ইউরোপীয় খ্রিস্টিয় ঐতিহ্যের গহ্বরে পড়ে খ্রিস্টিয় ধর্ম ও ইসলামের মতো আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহ্যের মধ্যে হজম হয়ে গেল। আধুনিক রাষ্ট্রের সুবাদে যে রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা তার মধ্যে অন্যান্য ধর্মের মতো হিন্দুও সেঁধে গেল। বিজেপি যতবেশি হিন্দু ধর্ম বা হিন্দুত্বকে রাজনীতিতে টেনে আনবে ততটাই সে আর ‘হিন্দু’ কিংবা ভারতীয় থাকবে না। অথচ এই বিকৃতিই তার হিন্দুত্বের বড়াই হয়ে উঠবে। কারণ এই ‘হিন্দুত্ব’ বা ধর্মের ধারণা সিন্ধু নদীর তীরে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা ‘হিন্দু’ বা ভারতীয় ঐতিহ্যের বাইরের জিনিস, বাইরে থেকে আমদানি করা ব্যাপার। মোদি হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি কি? নাকি হিন্দুত্ববাদী আত্মপরিচয়ের বা আধুনিকতার প্রতিনিধি। যে পরিচয়ের নির্মাণ ঘটেছে নিউ লিবারেল বিশ্ব অর্থনীতির গর্ভে ও পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ঔরসে। দুটোই আধুনিক জিনিস।
আধুনিক রাষ্ট্র কিভাবে ধর্মের চরিত্রে রূপান্তর ঘটায় সে বিষয়ে আমাদের হুঁশ নেই বললেই চলে। ধর্মের চরিত্রের মধ্যে আত্মপরিচয় তৈরির সুযোগ কতটা রয়েছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। ইসলাম ধর্ম পালন করা, আর মুসলিম পরিচয় নিয়ে নিজেকে একটি পৃথক রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আর ‘জাতি’ গণ্য করা দুটোই সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। মুসলামানদের অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ রয়েছে। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী যুগে মুসলমান হিসেবে নিপীড়িত শোষিত হবার ইতিহাস এবং আধুনিক রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে তার সমাধান বা মীমাংসার চেষ্টাকে আমরা সেভাবেই বুঝব। কিন্তু ধর্ম হিসেবে মানবেতিহাসে ইসলামের প্রস্তাবনা ও সম্ভাবনাকে কি সেভাবে বোঝা যাবে? এটাই একালের গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা। সব ধর্ম এবং ধর্ম পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতির ফারাকের মধ্যে মানুষের চিন্তার অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন দিকগুলো সম্প্রতি আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে।
কথাগুলো বলছি কারণ ধর্মের রাজনীতি নিয়ে যে সকল আলাপ আলোচনা আমরা দেখি তার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মের কোনো সম্বন্ধ নেই। সেটা আসলে ধর্মভিত্তিক আত্মপরিচয় এবং আধুনিক সমাজ ও আধুনিক রাষ্ট্রের সমস্যা। অর্থাৎ আধুনিকতা ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতির প্রবলেম। এই দিকটি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন করা গেলে হয়তো বাংলাদেশে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে যে সকল (কু)তর্ক চলে তার অবসান হবে; আমরা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও বিচক্ষণভাবে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে পারব। এটা সত্যি যে ধর্মের সঙ্গে সমাজ, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি ধর্মের সঙ্গে চিন্তার সম্পর্ক আমরা মীমাংসা করতে পারিনি। কিন্তু সেটা আমাদের অক্ষমতা নয়, বরং তা আধুনিকতা ও আধুনিক রাষ্ট্রের অক্ষমতা যা ক্রমশ প্রকট হয়ে বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আধুনিকতা ও আধুনিক রাষ্ট্রের পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই সেই মীমাংসার পথে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
তবে শুরুতেই কিছু ফালতু তর্ক ও প্রপাগান্ডা পরিহার করা জরুরি। যেমন ধর্ম মাত্রই সহিংসতার জন্ম দেয়। হোলি আর্টিজানের হত্যাকা- এই কুতর্ককে উসকে দেবে এবং দিচ্ছে। এই ফালতু বক্তব্যের পক্ষে কোনো বাস্তব তথ্য নেই। এই দাবির অসারতা প্রমাণের জন্য সেই পুরনো যুক্তিই যথেষ্ট যে দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ পঙ্গু হয়েছে। কিন্তু এই দুটো যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধ ছিল না। দুটো যুদ্ধই ছিল আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আধুনিক বিশ্বযুদ্ধ। হত্যা করা হয়েছে জাতির নামে, রাষ্ট্রের নামে।
হোলি আর্টিজানের হত্যাকা- নির্মম ও নিন্দনীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু এই ক্ষেত্রেও মৃতের সংখ্যা বাংলাদেশের পুলিশ, র্যাব, বিজেবি এবং অন্যান্য বাহিনীর হাতে এ যাবতকালের সংগঠিত হত্যাকা-ের চেয়ে বেশি নয়। নৃশংসতার তুলনা করলে পুলিশি নির্যাতন, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, গুম খুন, রিমা-ের নির্দয় নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথাও ভেবে দেখতে হবে। আধুনিক গণমাধ্যম, আধুনিক রাষ্ট্রের স্বার্থে, আধুনিক রাষ্ট্রের নৃশংসতাকে নিয়মিত আড়াল করে। নজরের বাইরে নিয়ে যায়। গণমাধ্যম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন