১৫ আগস্ট-এর হত্যা কি গণহত্যা নয়?
সিলভিয়া পারভিন
১৯৭৫ সাল, ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জন্য একটি কলঙ্কময় দিন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে হুঙ্কার করে একদিন যে তর্জনির গর্জনে কেঁপে উঠেছিল সারা বাংলা, এদিনে সে স্বাধীন বাংলাতেই তার তর্জনিকে চিরদিনের জন্য নিস্তেজ করে দেয় ঘাতকের বুলেট। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে বিভোর বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাকে একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, সঙ্গে যোগ হলো দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। একাত্তরে পাকিস্তানি হায়েনারা শেখ মুজিবকে হত্যা করার সাহস পায়নি। যাদের মুক্তির জন্যে বঙ্গবন্ধু তার সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, সে বাঙালিই বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিল তার বুক।
পঁচাত্তরের সেই অভিশপ্ত দিনে বিশ্বাসঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি। একে একে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বড় ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, ছোট ছেলে শেখ রাসেল, দুই ছেলের বউ সুলতানা কামাল এবং রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এস বি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহাবুবুল হককে। ঘাতকেরা সেদিন ৩২ নম্বর বাড়ি ছাড়াও আরও এক বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করে। সেখানে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে, যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাতকে, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুবান্ত বাবু, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাতসহ একজন পারিবারিক আত্মীয় বেন্টু খানকে।
১৯৭১ সালের পর ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এর মতো নির্মম হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও ঘটেনি। ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ঈঙঘঠঊঘঞওঙঘ ঙঘ ঞঐঊ চজঊঠঊঘঞওঙঘ অঘউ চটঘওঝঐগঊঘঞ ঙঋ ঞঐঊ ঈজওগঊ ঙঋ এঊঘঙঈওউঊ নামে একটি রেজুলেশন পাশ হয়। গণহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে সে রেজুলেশনের ২৬০(৩) ধারার অনুচ্ছেদ ২ এর ১ নম্বর পয়েন্টে বলা আছে, ‘পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য তাদের সদস্যদেরকে হত্যা বা নিশ্চিহ্নকরণ’। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির স্থপতি। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যারা বাংলাদেশ চায়নি তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বাংলাদেশকে মুছে দিতে চেয়েছিল। আবার ৪ নম্বর পয়েন্টে বলা আছে, ‘এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর জীবনধারণ কষ্টসাধ্য, সেই সঙ্গে জন্ম প্রতিরোধ করে জীবনের চাকা থামিয়ে দেওয়া হয়’। এই জঘণ্য খুনিরা সেদিন রাতে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে হত্যা করেছে। নববধূকে হত্যা করেছে। ছোট শিশু শেখ রাসেলকে হত্যা করেছে। তারা এতটাই পশু যে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও ছাড়েনি যে নারীর গর্ভে বেড়ে ওঠা শিশু পৃথিবীর নির্মম নিষ্ঠুরতা দেখারও সুযোগ পায়নি। গণহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারণের পর ধারা ৩ এ গণহত্যা সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহও চিহ্নিত করা হয়েছে।
১. গণহত্যা চালানো, ২.গণহত্যা চালানোর ষঢ়যন্ত্র বা পরিকল্পনা করা, ৩. প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে গণহত্যা উস্কে দেওয়া, ৪. গণহত্যা চালানোর চেষ্টা করা, ৫. গণহত্যায় যেকোনো প্রকারে সহযোগী হওয়া ও সমর্থন করা।
জাতিসংঘের এই রেজুলেশন অনুযায়ী পঁচাত্তরের সেই নির্মম ঘটনাটি কেবল কোনো সাধারণ হত্যা নয়, বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত গণহত্যা এটি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে (যদিও অনেকে এখনও পলাতক)। কিন্তু লক্ষ্য করুন, জাতিসংঘের সেই রেজুলেশনে উল্লেখিত গণহত্যা সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহের ৫ নম্বর পয়েন্টে লেখা আছে, ‘গণহত্যায় যেকোনো প্রকারে সহযোগী হওয়া ও সমর্থন করা’। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যায় যারা পরোক্ষভাবে মদদ দিয়েছে তারাও কিন্তু এই গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী কিংবা সমান অপরাধী। আজ হয়তো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু পরোক্ষ মদদ দাতাদের বিচার হয়নি। তাই আজ সময় এসেছে ১৫ আগস্টের গণহত্যায় সাহায্যকারীদের বিচারের আওতায় আনার।
লেখক : পরিচালক, রেডিও ঢোল এফএম ৯৪.০। প্রতিষ্ঠাতা, দ্য লাভলি ফাউন্ডেশন
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন