ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার হতে পারে সংশোধনাগার
বিশেষ প্রতিবেদক : পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোড থেকে কেরানীগঞ্জে নতুন কারাগারে স্থানান্তরিত হয়ে আসা বন্দিজীবন সম্পর্কে বন্দিরা জানিয়েছেন, ভালো ও এমন সুন্দর পরিবেশ আগে কখনো ছিল না। আগে গোসল ছিল এক ভয়াবহ বিষয়। এখন গোসল ও খাবারের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা এবং দিন-রাত সব সময়ের জন্য টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা। এখন প্রায় সাত হাজার কারাবন্দি উপভোগ করছে মুক্ত বাতাস ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। জামিন পাওয়া বন্দি, কারা কর্মকর্তা, কর্তৃপক্ষ এবং বন্দিদের আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এ চিত্র। পুরনো কারাগার থেকে দ্বিগুণের বেশি পরিসরে অধূমপায়ী, বৃদ্ধ ও কিশোরদের জন্য রয়েছে পৃথক থাকার ব্যবস্থা। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে কারা কর্তৃপক্ষ বলেছেন, কারাগার পরিচালনায় কিছু সমস্যা থাকলেও বন্দির নিরাপত্তায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে নিñিদ্র নিরাপত্তার জন্য কারা এলাকার সীমানা প্রাচীরটি খুব দ্রুত নির্মাণ করা প্রয়াজন। সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, প্রথম প্রথম যে কেউ কোনো স্থানে গেলে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এক্ষেত্রেও তাই অনেক সমস্যা হচ্ছে। তবে খুব প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা প্রাথমিকভাবে ৩৬টি কারণ চিহ্নিত করে এগোচ্ছি।
পাশাপাশি নতুন জায়গার কারণে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতে সমস্যা, বৈদ্যুতিক সমস্যাসহ বেশকিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে খাবার সরবরাহে বিলম্ব। আয়তন ও বন্দি ধারণক্ষমতায় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এ কারাগারটি আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন কারাগার হিসেবেই তৈরি করেছে বর্তমান সরকার। বন্দিদের বেশি সুবিধা প্রদানের জন্য বিশাল এ কারাগারটি তৈরিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারা কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন সময় নানা নির্দেশনা করেছেন।
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের তুলনায় আয়তনসহ প্রায় দিক দিয়েই দ্বিগুণÑ কোনো কোনো দিক দিয়ে তিনগুণ বেশি সুবিধাসম্পন্ন করেই তৈরি করা হয়েছে কেরানীগঞ্জের এ নতুন কারাগারটি। কারা কর্তৃপক্ষ নতুন কারাগারটিতে বন্দির সুবিধার্থে দেশে প্রথমবারের মতো কিছু নতুন সুবিধা প্রদান কার্যক্রম চালু করেছে। যা ব্যতিক্রমী অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে কেরানীগঞ্জের এ কারাগারটিকে।
গণপূর্ত অধিদফতরের সহায়তায় নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা গেলে নতুন কারাগারটিতে পুরনো কারাগারের তুলনায় বন্দিদের তিনগুণ বেশি সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে বলে কারাসূত্র নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একসঙ্গে একদিনে এত বন্দি স্থানান্তর এই প্রথম।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে সাজা ভোগ করা পুরনো কয়েদিদের মতে, বর্তমানে এটিই হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন আধুনিক কারাগার। কারাবন্দি ছিলেন, আব্দুল মতলুব মিয়া। সম্প্রতি এ জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তার মতে, মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে থাকার স্থান ও টয়লেটসহ গোসলের সমস্যা। যা এ কারাগারে একদমই নেই। নতুন এ কারাগারের করতোয়া নামের একটি ভবনে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বৃদ্ধ, কিশোর ও অধূমপায়ী বন্দিদের জন্য আলাদা সেল গঠন করা হয়েছে। এ কারাগারটি শুধু কারাগারই নয়, এটি হোক সংশোধনাগার।
জানা গেছে, নতুন কারাগারটিতে বন্দিদের বিনোদনের জন্য কারাভ্যন্তরের কেস টেবিলের সামনে বিশাল একটি সাউন্ড বক্স রাখা হয়েছে। সেখানে বন্দিরা ইচ্ছেমতো তাদের পছন্দের গান শুনতে পারছেন।
কারাসূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নতুন এসব চুলায় বন্দিদের রান্নার কাজ শুরু করার ফলে সঠিক সময়েই খাবার পাচ্ছেন না। পরবর্তীতে গ্যাস সংযোগ পাওয়া গেলে পুনরায় আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি এসব বন্ধু চুলায় রান্নার কাজ শুরু করা হবে। বর্তমানে নিয়মিত তিন বেলায় গড়ে ২১ হাজার বন্দির জন্য রান্না করতে হচ্ছে। যা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য কষ্টসাধ্য। চুলার জন্য শত শত মণ কাঠের লাকড়ির প্রয়োজন হচ্ছে।
আগের কারাগারটিতে ২ হাজার ৬৮২ বন্দর স্থলে প্রায় ৮ হাজার ন্দিকে রাখা হতো। এ কারাগারটিতে প্রায় সাড়ে চার হাজারের স্থলে দ্বিগুণ রাখা সম্ভব হবে। জানা গেছে, জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী প্রতিটি বন্দির থাকার জন্য স্থান (টয়লেট, বারান্দা ও থাকার স্থানের মাঝখানের ফাঁকাসহ) মোট ৩৫ স্কয়ার ফুট স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। বন্দির সুবিধার্থে নতুন কারাগারটিতে প্রতিটি বন্দির জন্য সব মিলিয়ে ৯০ স্কয়ার ফুট করে জায়গা। যা জাতিসংঘের দেয়া স্থানের তুলনায় কারাগারটিতে প্রায় ৩ গুণ বেশি স্থান রাখা হয়েছে। ফলে বন্দিরা থাকতে পারছেন।
নতুন কারাগারটির প্রকল্প এলাকায় মোট ১৯৪ দশমিক ৪১ একর জমির উপর তৈরি করা হয়েছে।
একজন সিনিয়র কারা কর্মকর্তা বলেন, পুরনো কারাগারটির জায়গায় অনেক কিছু করার কথা রয়েছে। সিদ্ধান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এর ভেতর সাধারণ মানুষ ঢোকার সুযোগ পাবে না।
বন্দিদের নতুন ঠিকানা কেরানীগঞ্জ কারাগার হয়েছিল ২৯ জুলাই।শুক্রবার ভোর সাড়ে ৬টা থেকে রাত পৌনে ১০টার মধ্যে ছয় হাজার ৩১১ জন বন্দিকে প্রিজন ভ্যানে করে সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে কঠোর নিরাপত্তার কারণে কোনো রকম সমস্যায় পড়তে হয়নি। বন্দিরা নতুন কারাগারে যেতে পেরে আনন্দিত। তার বহিঃপ্রকাশও ঘটায় তারা। কোনো কোনো প্রিজন ভ্যানের বন্দিদের গান গাইতে শোনা যায়। শুধু তাই নয়, কারাগারের ভেতরে গিয়েও মনের ফুর্তিতে কিছু কিছু বন্দি গান গেয়েছে সেদিন। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, নতুন কারাগারের ভেতরে ঢোকার পর তারা আনন্দে হৈ-হুলোড় করে। প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে বন্দিদের সোজা নির্দিষ্ট সেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর নেছার আলম বলেন, কারাগার হতে পারে সংশোধনাগার। সরকারও কারাগারেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক তা চাইবেন না। কারাগারগুলোতে বন্দিদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা দিতে চাই। বর্তমান কারাগারের পরিবেশ, থাকার ব্যবস্থা, বন্দিদের অবস্থান, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের সবরকম সুযোগ রয়েছে। আমরা দুয়েকদিনের মধ্যেই ‘শেড’ নির্মানের কাজ শুরু করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে। রোববার এ প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দর্শনার্থীদের সুযোগ সুবিধা করছি আমরা। খোলামেলা পরিবেশ পেয়ে আনন্দিত তারা। একাধিক বন্দিও জানিয়েছে, নতুন কারাগারে ভালোই লাগছে। এই কারাগারে বন্দিরা থাকবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে।