নারীর কোনো মুক্তি নেই?
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সতীদাহপ্রথা, বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও নারীদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে, এর ফলে নারী তার আত্মশক্তি খুঁজে পেতে থাকে। নারীর সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের বিকাশ তরান্বিত হয়, অন্যদিকে নারী তার নতুন জীবনবোধ নিয়ে অনেকক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি অর্জন করে। বিংশ শতাব্দী নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এই শতাব্দিতে নারীরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। আর একবিংশ শতাব্দিতে এসে এই বাংলাদেশেও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছে।
আমরা যদি নারীর অর্থনৈতিক অবস্থান সেকাল ও একালের চিত্রের ভিত্তিতে টেনে আনি, তাহলে বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করব। গোলাম মুরশিদ তার ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ গ্রন্থে উনিশ শতকে নারীদের অর্থনৈতিক ভূমিকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন; ‘সেকালে বঙ্গমহিলাদের মধ্যে কেবল দাসী, অশিক্ষিত ধাই এবং বারবণিতাদেরই স্বাধীন আয় ছিল। তাছাড়া, শ্র্রমজীবীদের মধ্যে মহিলারা গৃহপালিত জন্তুদের খাইয়ে, গরু দুইয়ে, ধান ভেনে এবং মাছ বিক্রি করে তাদের অর্থনৈতিক কার্যে সহায়তা করতেন। ফসল রোপণ করে এবং কেটেও অনেক মহিলা অর্থনৈতিক কার্যে সহায়তা করতেন। সংক্ষেপে নগদ অর্থ আয় করুন বা নাই করুন, নিম্নশ্রেণির মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতেন। এটা করার জন্য তাদের স্বাভাবিকভাবেই পর্দা প্রথা অমান্য করতে হতো। তাছাড়া, ভদ্রলোক পরিবারে মহিলাদের যে মর্যাদা ছিল, নিম্নশ্রেণির পরিবারে তা ছিল উন্নততর। ভদ্রলোকদের মধ্যে মহিলারা কোনো অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতেন না, অন্তত অর্থ আয় তো করতেনই না। বস্তুত, তাদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশ গ্রহণের বিরুদ্ধে মনোভাব প্রচলিত ছিল।’
উনিশ শতকের মহিলাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ফলেÑ তারা ঘরের গ-ির বাইরে গিয়ে জীবন বিকাশের শক্তি অর্জন করতে থাকেন, এর ফলে এসময়ে নারীরা শিক্ষিত হয়ে পারিবারিক দায়িত্বের বাইরে পেশাগতভাবে বিভিন্ন বৃত্তিতে সম্পর্কিত হতে থাকেন। ধীরে ধীরে নারী কর্মজীবীদের সংখ্যা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এই সময়ে চিত্রটা আরও অনেক বদলিয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের চিত্রে নারীর যে অর্থনৈতিক অবস্থান খুঁজে পাইÑ তা দিনদিন অগ্রগতির চিহ্ন বহন করছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ ‘সিপিডি’র এক গবেষণাপত্রে, তারা উল্লেখ করেছেÑ ‘অর্থনীতিতে অতিদ্রুত বিশেষ করে চাকরি, ব্যবসায় নারীর সংখ্যা বাড়ছে। মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশ গ্রহণ ছিল ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৫.৮ শতাংশ, ২০০২-০৩ সালে ২৬.১ শতাংশ, ২০০৫-০৬ সালে ২৯.২ শতাংশ এবং ২০১১-১২ সালে ৩৯.১ শতাংশ।’ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস পোশাকশিল্প, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া, হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, চা শিল্পসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি নারী জড়িত। এসব শিল্পের প্রধান কাজগুলো করেন নারী।
উনিশ শতকে এসেও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে নারীরা ছিল পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। নারীদের শিক্ষার বিস্তার ও সুযোগ বিস্তৃত না হওয়ার কারণেও নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে জীবন নির্বাহ করত। আর্থিক ক্ষমতা না থাকার কারণে নারীরা ছিল আরও পরনির্ভরশীল, বিবাহিত জীবনে স্বামীর ওপর এবং অন্যান্য জীবনে অভিভাবকদের ওপর। এখন এই চিত্র বদলাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে।
নারীর কল্যাণবিরোধী সেই পুরনো অবস্থাটা শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আবার ফিরে আসুক, সেজন্য ‘হেফাজতে ইসলাম’সহ কিছু সংগঠনের লোকেরা বিভিন্ন মনগড়া কথাবার্তা শুধু বলে না, দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম ও বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে যে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তা ভেদবুদ্ধি দিয়ে রোধও করে দিতে চায়। বিশেষ করে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে আয়-উপার্জন করুক, স্বয়ম্ভর হোকÑ তা তারা চায় না! তাই, তারা কর্মজীবী নারীদের সম্পর্কে আপত্তিকর ও অশ্লীল কথাবার্তা বলতে দ্বিধা করে না। সে বিষয়ে নারীদের সবসময়ে সচেতন থাকতে হবে। এইসব জিকিরে পূর্বে কাজ হয়নি, এই সময়েও যেন না হয়, সেদিকে সবারই সর্তক থাকা জরুরি।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন