বিরূপ বিশ্বে সাহসী মানুষ
ডা. সুব্রত ঘোষ
আমাদের স্বাধীন দেশের মানুষের মাঝে আত্মকেন্দ্রিকতা অতিমাত্রায় ভর করেছে। তাই নিকট অতীতের সত্যেন সেন, রণেশ দাশ গুপ্ত, সরদার ফজলুল করিমদের উত্তরসূরীর সংখ্যা আজ একেবারেই হাতে গোণা। এমন দুর্লভ দৃশ্যে যিনি স্ববিরোধী নন, দর্শনে নন বিচলিত, বিদ্যা অর্জনে যার উপার্জন ভেজালমুক্ত, যিনি মানবমুক্তির পথের অনুসন্ধান করতে করতে ভোগবাদী ফাঁদে এক মুহূর্তের জন্যও ধরা দেননিÑ এমন ব্যতিক্রমী একজন মানুষ, আমাদের যতীন সরকার। যিনি নিপীড়িত মানুষের মুখচ্ছবি, দেখে দেখে সাদা-সরল জীবনে অভ্যস্ত হয়েছেন। যতীন সরকার মোটেও বিদ্যাজীবী নন, বিদ্যাকে তিনি জীবিকার আশ্রয়ে প্রশ্রয় দেননি। জীবনের জন্য বিদ্যা, মানুষের জন্য বিদ্যা এই মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েই তিনি বুদ্ধিজীবী। তিনি সময়ের ভবিতব্য প্রত্যক্ষ করেন দূরদৃষ্টি দিয়ে। তার জীবন আত্মতৃপ্তিতে ভরা। অনেকের সেই তৃপ্তি নেই। দারিদ্র এবং গৌরবের যুগলমঞ্চে আসীন হওয়া সবার ভাগ্যে জোটেনি। এ গৌরব তিনি অর্জন করেছিলেন অনেক কঠিন পথ মাড়িয়ে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে, অর্থ উপার্জনের বদলে গৌরব অর্জনে মনোনিবেশ করেছেন। এভাবেই তার জীবন নাট্যে আসে অবিরাম গতি। সে গতির নামই প্রগতি।
তার লেখা পাঠককে সর্বদা জাগ্রত করে। ভাবিত করে, কখনও কখনও দুর্বল ভাবনার অবসান ঘটিয়ে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করে যাচ্ছেন তিনি। পাঠকবৃন্দ তার ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’ এর মাধ্যমে তার প্রকৃত সত্তার পরিচয় পেয়ে যান। ২০০৪ সালে গ্রন্থাকারে এটি প্রকাশিত হলে দেশময় সাড়া পড়ে যায়। এ গ্রন্থই তাকে পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসে। তারপর ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার’ (২০০৫), ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (২০০৭) এবং ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (২০১০)। দর্শনের হালকা রসিকতার মধ্যে দিয়ে ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’ গ্রন্থটি সাম্প্রদায়িকতা, দ্বিজাতিতত্ত্ব, হিন্দু মধ্যবিত্তের মানস সংকটে গ্রামীন ও শহরে সমাজের ইতিবৃত্ত এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই উপমহাদেশের ধর্মের অভিজ্ঞতা বড়বেশি তিক্ত। ধর্ম মানে এখানে সাম্প্রদায়িকতা। প্রথমে ঘৃণা তারপর হানাহানি। ব্রিটিশের অন্তিম পর্ব থেকে পাকিস্তানের অন্তিম পর্বটিতে ধর্মের যে বিরূপ চিত্রটি তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তা তার বক্তৃতা এবং লেখায় বিচিত্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মের নেতিবাচক দিক তিনি যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন, তেমনি ইতিবাচক রূপও কম দেখেননি।
সে ধর্মের মর্ম কথার মধ্যেও শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার বীজমন্ত্রটিও খুঁজে পেয়েছেন তিনি। উপমহাদেশের ধর্ম বাস্তবতা তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞজনোচিতভাবে আয়ত্ত এবং সুবুদ্ধি দিয়ে ব্যবহার করেছেন। ধর্ম মূলত, আত্মশক্তি লাভ এবং আত্মবিকাশের জন্য। তা কখনও মানুষের সাম্প্রদায়িকতার কারণ হতে পারে না। এসব কথা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং লোকায়ত জীবনের হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের ভিতর থেকে। সাম্প্রদায়িকতা এবং কুসংস্কাররূপী ব্যাধিগুলো একদিন লোকায়ত প্রভাবেই সেরে উঠবে, এ ব্যাপারে তিনি প্রত্যয়দীপ্ত। বাগ্মীরূপী যতীন সরকার বাংলাদেশের প্রগতির পথনির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে গড়ের মাঠ পর্যন্ত সমাজের নানাবিধ বিষয়ে সচেতনতামূলক বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে জাগাবার চেষ্টা করেছেন। সত্যেন সেনের গড়া উদীচী, বাংলদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তাকে সাহায্য করেছে। উপান্তবেলায়, উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটির হাল ধরেছেন সফলভাবেই। সভাপতি হবার পর দেশ-বিদেশে নিজস্ব ঢঙের বক্তৃতা আগামী দিনের কমরেড তৈরি করার পথ, কিছুটা হলেও সুগম হয়েছে। অগণিত হতাশার মাঝেও তিনি ছিলেন প্রান্তিক অবহেলিত মানুষের আশার আলো’।
৭২-এর সংবিধান ভূলুণ্ঠিত, দেশের মৌলনীতি থেকে সমাজতন্ত্র উচ্ছেদ, বৈশ্বিক পরিম-লে সমাজতন্ত্রের আপাত বিপর্যয়েও তিনি অকপট ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো কলম চালিয়ে যানÑ আমাদের জাগান। তার লেখা মৌলবাদী, শোষক-সাম্প্রাদায়িক ভেদ বুদ্ধি সম্পন্ন মধ্যবিত্ত, পুঁজিবাদ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী, নিপীড়নবাদী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, সর্বদাই উচ্চকণ্ঠী। উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রকৃত অভিসারী তিনি।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন