আওয়ামী লীগে ফিরছেন বিএনপির মনজুর
এম কবির : ফের আলোচনায় চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মনজুর আলম। গত বছর ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিাযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বিএনপি নেতা এম মনজুর আলম। একইসাথে আর রাজনীতি করবেন না ঘোষণা দিয়ে মনজুর বলেন, ‘আমি আর রাজনীতি করব না। সমাজসেবা নিয়েই থাকব।’ কিন্ত কথা রাখতে পারলেন না তিনি। এক বছর চার মাসের মধ্যে আবার তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হবার ঘোষণা দিলেন। গত মঙ্গলবার জাতীয় শোক দিবসের দিনই তিনি পুনরায় ফিরে এলেন আওয়ামী লীগে। বললেন, ‘অভিমান করে কিছুদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির বাইরে গেলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাইরে ছিলাম না কখনো। আমাদের পরিবার এখন একই আদর্শে বিশ্বাসী এবং আওয়ামী লীগের পতাকাতলেই সংঘবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম। তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিশ্বশস্ত হিসেবে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১৮ বার পালন করেছেন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হলে টানা দুই বছর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন বছর ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল থেকে মেয়র প্রার্থীর মনোনয়ন চান। কিন্তু এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। তখন বিএনপি থেকে মনজুর আলমকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে।
প্রায় দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে শিষ্য মনজুরের কাছে পরাজিত হন তিনবারের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। নির্বাচিত হওয়ার পর দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করেন মনজুর আলম। এর কিছুদিন পর তাকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়। মেয়র হিসেবে ভাল মানুষ পরিচিতি পেলেও দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় না থাকায় অসন্তোষ ছিল বিএনপিতে। তবে পাঁচ বছরে দলে আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছেন মনজুর আলম। এরপরও তাকে বিএনপি নেতাদের নানা ধরনের অভিযোগ-অনুযোগ শুনতে হয়েছে নিয়মিত।
ফলে একদিকে রক্তে মিশে থাকা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের নেতিবাচক মনোভাবে মনজুর আলমের কাছে রাজনীতি বিরক্তিকর হয়ে উঠে। দলের জন্য অনেক কিছু করেও প্রশংসা না পাওয়ায় কষ্ট পেয়েছেন। এরপরও ২০১৫ সালে বিএনপি থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা হলে নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনে প্রতি পদে পদে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে তাকে এবং তার পরিবারকে। চট্টগ্রাম বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের খেসারত দিতে হয়েছে আর্থিক ও মানসিকভাবে। ফলে তখনই বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে খুব কৌশলে নির্বাচনের দিন সকাল ১১টার দিকে নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দেন মনজুর আলম। ওই সময় তিনি ভারাক্রান্ত মন ও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়লেও রাজনীতি ছাড়ার কোন কারণ ব্যাখ্যা করেননি।
এদিকে মন্জুর আলমের ফিরে যাওয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির নবনির্বাচিত সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘মন্জুর আলম কখনই বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। ছিলেন সুযোগসন্ধানী। তার মতো ভিন্নমতাদর্শের রাজনীতিকদের বিএনপিতে এনে “দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা”র শামিল বলে আমি মনে করি। এবং আজকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। দুর্বল হলেও প্রয়োজনে নিজেদের কাউকে নার্সিং করে দলে প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তাতে লাভ হয় বেশি, ক্ষতি হয় না।’
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল এজেন্ট ঢুকতে না দেয়া, মারধর, কেন্দ্র দখল, কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট বর্জন করেন ২০ দলীয় জোট সমর্থিত ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের প্রার্থী এম মনজুর আলম। একই সাথে রাজনীতি থেকে অবসরেরও ঘোষণা দেন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মনজুর আলম।
রাজনৈতিক গুরু এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন এম মনজুর আলম। ভোটের কারণে দল পরিবর্তন করলেও গুরুভক্তি ছিল শতভাগ। ফলে মেয়রের আসনে বসে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেওয়া কোন সিদ্ধান্তকে তিনি অবমূল্যায়ন করেননি। বরং যথাসম্ভব সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
বিশ্বস্ত মানুষগুলো দূরে সরে যাওয়ার কারণেই মহিউদ্দিন চৌধুরী কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে মনে করেন তারই বিশ্বস্ত শিষ্য এম মনজুর আলম।
তবে তার মতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিকল্প কোন নেতা নেই। মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে মনজুর আলম বলেন, ‘উনি (মহিউদ্দিন চৌধুরী) অনেক সময় একটু রেগে কথা বলেন। কিন্তু মানুষকে অত্যন্ত ভালবাসেন। বকা দিলেও যে কোন কাজ তিনি করে দেন। সারাজীবন কেবল মানুষের উপকারই করেছেন। উনার মত দেশ প্রেমিক দ্বিতীয় কোন রাজনীতিবিদ চট্টগ্রামে নেই। ‘
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মন্জুর আলমের বাবা আমৃত্যু আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আবদুল হাকিম কন্ট্রাক্টর স্বাধীনতার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। স্বাধীনতার পর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য। মন্জুর আলম নিজেও আওয়ামী লীগের হয়ে তিনবার সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন।
এবার নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’-এর ব্যানারে এম মন্জুর আলম পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকী। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দুস্থদের মধ্যে বস্ত্র ও খাবার বিতরণ করা হয়। শোক দিবসের দিন সকালে নগরীর উত্তর কাট্টলী বাগানবাড়িতে খতমে কোরআন, দোয়া, মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করেন তিনি।
মন্জুর আলম বাংলাদেশ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি আওয়ামী পরিবারেরই সন্তান। আমার রাজনৈতিক আদর্শ বঙ্গবন্ধু। আমার প্রধান ধর্ম হচ্ছে মানুষের সেবা করা, জনগণের কল্যাণ করা। তাই বৃহৎ পরিসরে জনসেবা করতে গিয়েই আমি অন্য দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম।’ বঙ্গবন্ধুকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছাকে আমার মায়ের মর্যাদা দিয়েছি। আগামী প্রজন্মও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করবে। আমার ১১ বছরের এক নাতি শেখ রাসেল জাতীয় শোক দিবস উদ্যাপন পরিষদের আহ্বায়ক। আমাদের পুরো পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী।’ সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ