ফ্রান্সে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার কমছে কেন?
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী
প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলরের উদাসীনতায় ফ্রান্সে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার হ্রাসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আওডি এ-৫ গাড়ি পেয়ে নিজের ভোগবিলাস-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করলেও ফ্রান্সে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে কোনো ভূমিকা নিচ্ছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা গেছে, ফ্রান্সের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি সম্প্রসারিত হওয়ার বদলে ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে।
জানা যায়, উইংয়ে বর্তমান কাউন্সিলরের যোগদানের আগে ফ্রান্স ছিল বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চার নম্বর শীর্ষ দেশ। বর্তমানে ফ্রান্সের অবস্থান পাঁচ নম্বরে নেমে এসেছে এবং সূচক দিন দিন নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্বস্ত সূত্রমতে, গত চার বছরে এই কর্মকর্তা ফ্রান্স সরকারের বাণিজ্য বা অর্থনীতি বিষয়ক কোনো মন্ত্রণালয় বা অফিসে কারো সাথে কখনো দেখা করেননি। দূতাবাসের সন্নিকটে অবস্থিত বৃহৎ দাতা দেশগুলোর সংগঠন ও ই সি ডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট) এ তিনি যান না। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ওইসিডি’তে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য যখন দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তা,সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাসহ বিজিএমইএ’র শীর্ষ নেতারা মরিয়া হলেও লবিং করতে থাকেন,তখন কমার্শিয়াল কাউন্সিলরের কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ফ্রান্সে নিয্ক্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এর এলাকার লোক হিসাবে দূতাবাসে সব কর্মকর্তার সমীহের পাত্র হয়েও তিনি নিজের দক্ষতা দেখাতে পারেননি। ফরাসি ভাষায় দখল আছে এমন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অনেক যোগ্য প্রার্থীকে ডিঙিয়ে প্যারিসে কমার্শিয়াল কাউন্সিলর হিসেবে তিনি পোস্টিং নিয়েছেন। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে দূতাবাসে যোগ দেওয়ার পর প্রায় চার বছর অতিবাহিত হলেও কাজ চালানোর মতো ফরাসি ভাষা আয়ত্ত করতে পারেননি এই কর্মকর্তা। ফলে ফ্রান্সের সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ফরাসি ব্যবসায়ী সমাজের মূলস্রোতের সঙ্গে যোগাযোগ সযতেœ এড়িয়ে চলেন। তিনি কোনো ফরাসি ক্রেতা বা উদ্যোক্তার সাথে দেখা পর্যন্ত করেন না। মূলত প্যারিসের বাঙালি পাড়ার ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগের মধ্যেই তার কার্যক্রম সীমিত। এর ফলে বাণিজ্যিক উইং এর মূল কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
রপ্তানি উন্নয়নের কাজে মনোযোগ দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার সতর্ক করলেও কোনো কাজ হয়নি। নতুন ক্রেতা খোঁজ করা দূরে থাক, দীর্ঘ চার বছরে তিনি বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত ফরাসি কোম্পানির তালিকাও প্রস্তুত করতে পারেননি বলে জানা যায়। ঢাকা থেকে পাট, চামড়া বা সিরামিক রপ্তানিকারগণ এসব পণ্যের ফরাসি আমদানিকারকদের তালিকা চাইলে তিনি তাদেরকে তালিকা সরবরাহ না করে প্যারিসের আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণের উপদেশ দিয়েছেন বলে জানা যায়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজিএমইএ যখন প্যারিসে বাটেক্সপো মেলার আয়োজন করে তখন তিনি ফরাসি ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা করেননি। এমনকি ওই সময় তিনি এক মাসের ছুটিতে দেশে চলে যান। জানা যায়, ওই সময় দূতাবাস অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তড়িঘড়ি একটা তালিকা প্রস্তুত করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। কমার্শিয়াল কাউন্সিলরের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে ঢাকার তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকগণ চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলে জানা যায়।
সূত্রমতে, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রপ্তানি সঙ্কুচিত হতে থাকলেও কাউন্সিলর নিজের স্বাচ্ছন্দ্য সম্প্রসারিত করতে তার পুরানো ফরাসি গাড়িটি বদল করে জার্মানি থেকে ৩৫ লক্ষ টাকা দামে নতুন গাড়ি এনেছেন। প্রথমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আওডি এ-৩ গাড়ির জন্য অনুমোদন দিলেও তিনি তদবির করে উচ্চতর মডেলের আওডি এ-৫ সিরিজের দামি গাড়ি কেনার অনুমোদন বের করে আনেন। নতুন গাড়িতে চড়ার উৎসাহে পুরনো গাড়িটি বিক্রির দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যাওয়ার উৎসাহও বোধ করেননি তিনি। আগের গাড়িটিকে জাঙ্ক হিসেবে দেখিয়ে বিনামূল্যে স্ক্র্যাপিং কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেছেন। এতে সরকার আগের গাড়ি বিক্রির অর্থ থেকে বঞ্চিত হয়।
দূতাবাসের একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে শুধুমাত্র এই কর্মকর্তার ব্যক্তিগত বেতন,ভাতা, চিকিৎসা ইত্যাদি বাবদ সরকার প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এছাড়া প্যারিসের বিভিন্ন মেলায় বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি উৎসাহিত করার জন্য দুই দফায় আরও দেড় কোটি টাকা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে পাঠানো হয়। এই বিপুল অর্থ খরচের বিনিময়ে তিনি গত এক বছরে একজন নতুন ক্রেতাকেও বাংলাদেশে পাঠাতে পারেননি। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার পরে তার পক্ষ থেকে ফরাসি ক্রেতাদেরকে আশ্বস্ত করার কোনো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী এবং ফরাসি-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে ভূমিকা রাখতে পারে এমন ব্যবসায়ীদের তালিকাও তার কাছে নেই।
জানা গেছে, ফিরোজ উদ্দিনের কার্যকলাপে দূতাবাসের শৃঙ্খলা ও কর্ম পরিবেশেরও অবনতি হয়েছে। মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার অধিকারী এই কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি ও দূতাবাসের প্রোগ্রামে অফিসারদের স্ত্রীদের অংশগ্রহণকে বিরূপ চোখে দেখেন। জানা গেছে, বাণিজ্যিক কাজে সহায়তা করার জন্য ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী মিস মেরিন জু-কে বাণিজ্য সহকারী ও অনুবাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। উক্ত কর্মকর্তার যৌন হয়রানিমূলক আচরণে এই বিদেশি মহিলা ছয় মাসের মাথায় চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি অফিস চলাকালীন ইন্টারনেটে কুরুচিপূর্ণ সাইটে বিচরণ করেন এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে একপর্যায়ে দূতাবাস আইটি বিশেষজ্ঞ ডেকে নোংরা ওয়েব সাইটে একসেস বন্ধ করে দেয় বলেজানা যায়। সম্প্রতি থুলুজে বাঙালি কমিউনিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই কমার্শিয়াল কাউন্সিলর এক প্রকাশ্যে মঞ্চে নৃত্যরত তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে উন্মাতাল নাচানাচিতে অংশ নিলে উপস্থিত অভ্যাগতরা বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তার এহেন কর্মকা-ে অবাক হয়ে যান।
রপ্তানি সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে কোনো কার্যকর ভূমিকা না রাখলেও উক্ত কর্মকর্তা বাংলাদেশি কমিউনিটির স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সম্প্রতি ফ্রান্স আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠনের জন্য আয়োজিত সম্মেলনের সময় তিনি প্রকাশ্যেই তার পছন্দের প্রার্থীদের হয়ে প্রচারণা চালান বলে কমিউনিটির লোকজনের নজরে পড়েছে। কমিউনিটির একাধিক সূত্র জানায়,ফিরোজ উদ্দিন কমিউনিটির সবার কাছে নিজেকে সরকারের কাছের লোক হিসেবে পরিচয় দেন। প্রথম দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা তার সরকারি দলের প্রতি খোলাখুলি সমর্থন দেখে মুগ্ধ হলেও পরবর্তীতে ফ্রান্স আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার কারণে অনেক পেনতা তার প্রতি বিরাগভাজন হন। তিনি অনেক পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতাকেও বিএনপি-জামায়াতের লোক বলে উল্লেখ করেন এবং দেশে-বিদেশে দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত কমিউনিটির অনেককেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলতে কুন্ঠিত হন না।
একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক জানিয়েছেন, শুধু প্যারিসে নয়,বরং অনেক মিশনেই উইং ভাগাভাগির সুযোগে অদক্ষতা প্রশ্রয় পায়। তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানান যে অন্য মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি পোস্টিং পাওয়া কর্মকর্তারা রাষ্ট্রদূতের নির্দেশ না মানলেও আন্ত:মন্ত্রণালয় সুসম্পর্কের কথা বিবেচনা করে প্রায়শ সমস্যাগুলো চেপে যাওয়া হয়। বর্তমানে দ্বৈত শাসনের কারণে রপ্তানি কেন বাড়ছে না তার কারণ খুঁজতে গেলে বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরস্পরকে দোষারোপ করার সুযোগ পায়,ফলে চূড়ান্ত বিচারে পেদশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মতে,এর তুলনায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পদ্ধতি অনুসরণ করে অর্থনৈতিক কূটনীতি যদি সরাসরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পেদওয়া হয়, তাহলে জাতি লাভবান হতে পারে।