২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ১৯ আসামি পলাতক, রায় হতে পারে নভেম্বরে
দীপক চৌধুরী : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ১৯ জন আসামি এখনো পলাতক রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বর্বরোচিত ও ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১২তম বার্ষিকী পালিত হবে আজ।
হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলার পৃথক চার্জশিটে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে উল্লেখ করে সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল মামলা সম্পর্কে বলেন, অভিযুক্তদের মধ্যে ১৯ জন পলাতক রয়েছে। তবে শিগগিরই এ মামলার রায় হতে পারে। হয়তো বা দুই-তিন মাস, অক্টোবরে-নভেম্বরে হতে পারে।
একাধিক প্রশ্নের জবাবে প্রধান কৌঁসুলি রেজাউর রহমান জানান, ২১ আগস্টের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদ-। তাই তারেক রহমানসহ কোন আসামির কী হবে, তা আদালতই ঠিক করবে। প্রধান কৌঁসুলিকে সহযোগিতা করেন আইনজীবী মো. আকরাম উদ্দিন। তিনি জানান, ওই ঘটনায় করা হত্যা মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত বর্তমান আসামি ৫১ জন।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। তিনিসহ এ মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন, অর্থাৎ কারাগারে ২৬ জন।
অপর ১৯ জন আসামি বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে দেশে আনার ব্যাপারে ইন্টারপোলের কোনো রকম সহায়তা পাওয়া যায়নি।
এ মামলার ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে গত বুধবার পর্যন্ত ২২৪ জনের সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়েছে। অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও রয়েছেন। তাদের মধ্যে অভিযোগ প্রমাণের জন্য যাকে যাকে প্রয়োজন মনে হবে, তাদের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আদালতে ডাকা হবে বলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা জানান।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা মনে করেন, দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির নেতাদের হত্যার উদ্দেশে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে এ জঘন্য হামলা চালানো হয়।
মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত এবং অপর ৫০০ জন আহত হন। শেখ হাসিনা ওই গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান। ওই সময় গুরুতর আহত হন ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ।
শুরু থেকেই গ্রেনেড হামলার তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। তদন্তের নামে বিষয়টিকে বিতর্কিত করার কাজ শুরু হয় সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ একটি মহলের প্রভাব ছিল বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল। এমনকি এই নিয়ে জজ মিয়া নাটকও সাজানো হয়েছিল। পরে একাধিক তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
ঘটনার গুরুত্ব নষ্ট করতে হামলার শিকার আওয়ামী লীগের দিকেই সন্দেহের আঙ্গুল তুলেছিল বিএনপি। ওই সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা তাদের বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ নিজেরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রচার চালান। হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলেও তখন একটা মহল থেকে প্রচারণা চালানো হয়।
ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে চারদলীয় জোট সরকার। সেই কমিশনও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপপ্রচারের পথ ধরেই চলেছিল। ১ মাস ১০ দিনের মাথায় কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়ে বলে, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, এই হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি। তবে ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন বৃহৎ প্রতিবেশী শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করেন।
সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২১ আগস্টের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলায় ২০০৮ সালের ১১ জুলাই প্রথম চার্জশিট দাখিল করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং ২১ জন হুজি নেতাকর্মীসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়।
পরে নতুন করে তদন্তের পরে ২০১২ সালের ৩ জুলাই অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে পৃথক দুটি সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করে। দুটি মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২।
বিএনপি-জামায়াত আমলে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচাতে মামলা ভুল পথে নিয়ে যেতে তদন্তকারীরা তদন্ত ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়।
অভিযুক্ত ৫২ জনের মধ্যে বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি আবদুল হান্নান বর্তমানে জেলে রয়েছেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলার সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডির সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান এবং আবদুর রশিদ জামিনে রয়েছেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডি এ মামলার অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। উভয় অভিযোগপত্র মিলে মোট আসামির সংখ্যা ৫২।
আসামিরা হলেনÑ তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক সাংসদ শাহ মোহাম্মদ কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম (ডিউক), এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম ও মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, পুলিশের সাবেক তিন আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি খান সাইদ হাসান ও মো. ওবায়দুর রহমান, জোট সরকারের আমলে মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আবদুর রশিদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ এবং হুজি-বির ১০ জন নেতা।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ হত্যা মামলায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে এবং বিস্ফোরক মামলায় ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক ছয় কর্মকর্তা, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান জামিনে আছেন। বাবর, পিন্টু মুজাহিদসহ ২৬ জন আসামি কারাগারে আছেন। পলাতক রয়েছেন ১৮ জন।
পলাতক ১৯ আসামি হলোÑ তারেক রহমান লন্ডনে, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ ব্যাংককে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ কলকাতায়, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোর্সালীন এবং তার ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন ভারতের কারাগারে এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে।
জঙ্গিনেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (পূর্ব) এবং উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান এবং খান সাঈদ হাসান বিদেশে অবস্থান করছে বলে সূত্র জানায়।
অভিযুক্ত পলাতক হারিছ চৌধুরী লন্ডনে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। পলাতকদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন ও বাবু এরা দুজন কারাবন্দি বিএনপি সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। পিন্টু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত। সম্পাদনা : রিমন মাহফুজ