
খিলাফত নয়, জঙ্গিদের টার্গেট জননেত্রী শেখ হাসিনা
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
আমাদের এখানে জঙ্গি হামলার সাম্প্রতিক তৎপরতার যে ব্যাপকতা, তা শুরু হয় মূলত গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগার এবং মুক্তমনা লেখকেদের হত্যার মধ্য দিয়ে। এরূপ ঘটনা মিশরেও ঘটেছিল। সেখানে ইসলামি ব্রাদারহুডের লোকেরা প্রথমে নাস্তিক, ধর্ম, নবী-রাসূলকে অবমাননা জঙ্গি হামলার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে। পরে দেখা গেল, তারা মুক্তমনা মানুষের উপরও আক্রমণ করছে। অর্থাৎ যারা একটু হলেও ধর্মনিরপেক্ষ এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের অতিমাত্রায় জড়াজড়ি পছন্দ করেন না, তাদের উপরও ব্রাদারহুড আক্রমণ পরিচালনা করে। বাংলাদেশেও কিন্তু এই ধারা অব্যাহত। এখানে প্রথমে লেখক, মুক্তমনা মানুষ, সাহিত্যিকদের আক্রমণ করেই শেষ হয়নি। যারা ধর্মীয় অনুশাসন এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে, তাদের বাইরে গিয়ে সাধারণ ধর্ম যাজক, পীর, গির্জার পুরোহিত থেকে শুরু করে নিরীহ জাপানি এবং ইতালির নাগরিকের উপর আক্রমণ করা হয়। এর দ্বারা স্পষ্টত, জঙ্গিরা তাদের লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তন করে। তারা শুরু করেছিল ব্লগার, কিংবা তথাকথিত ধর্ম অবমাননাকারীদের দিয়ে। পরে দেখা যায়, ধর্ম অবমাননা করার সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই, তাদেরকেও তারা হত্যা করে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তবে হত্যাকা- যে অজুহাতে হোক না কেন, তাদেরকে আগে গ্রেফতার করতে হবে। বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। কিন্তু সরকারের লোকজনের পক্ষ থেকে দুইটি বিষয়কে পাশাপাশি নিয়ে আসা হয়। এক. হত্যাকারীদের ধরার কথাও বলা হয়। দুই. হত্যাকারীদের অজুহাত ধর্ম অবমাননা অর্থাৎ নাস্তিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় নাস্তিকতাকে বরদাস্ত করা হবে না। এতে তখন অনেকে এই হত্যার পক্ষে প্রাসঙ্গিকতা বা যুক্তিকতা পেয়ে যায়। তবে ভাবনার বিষয় হচ্ছে, জঙ্গিরা হত্যা শুরু করেছে তথাকথিত নাস্তিক দিয়ে, কিন্তু তাদের শেষ পর্যন্ত টার্গেট হচ্ছে বর্তমান সরকার। ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়। আমরা যখন উন্নয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছি, উন্নয়ন সহযোগিরা আমাদের দেশে এসেছে, ঠিক তখনই জঙ্গিগোষ্ঠী উঠেপড়ে লেগেছে।
আমাদের মেট্রোরেলের পরামর্শদাতা হিসেবে জাপানের এক প্রবীণ ইঞ্জিনিয়ারসহ পোশাকশিল্পের ক্রেতাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন জঙ্গিদের টার্গেট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জঙ্গিরা এখানে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, তাদের লক্ষ্য হচ্ছেÑ বর্তমান সরকারকে বিব্রত করা এবং পারলে এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারকে বন্ধুহীন করা এবং সমস্যায় ফেলে তাদের প্রিয় অন্ধকারের শক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যারা জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলাসহ বাংলা ভাইয়ের উত্থানে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহযোগিতা করেছিল, তাদের আক্রমণের স্থান, কাল ভিন্ন হলেও আমি মনে করি, তাদের মূল লক্ষ্য শেখ হাসিনা এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার।
যদি ২১ শে আগস্ট হত্যাকা-ের বিচার করা যায় এবং সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হয় তাহলে জঙ্গিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তবে গ্রেনেড হামলার বিচার বিলম্ব হওয়া কাম্য নয়। গ্রেনেড হামলা ১২ বছর পেরিয়ে গেছে। এর কারণ, দীর্ঘদিন এই হামলার বিচার আটকে রাখা হয়েছিল। জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে এই হামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাসহ সর্বোচ্চ মহল এই ঘটনা ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রধান আশ্রয় ছিল হাওয়া ভবন। এখন গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সেই সময়ের সরকারি লোকজনের জড়িত থাকার বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। হরকাতুল জিহাদসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই হামলা ঘটিয়েছে। তবে গ্রেনেড হামলার মামলায় চারশ থেকে পাঁচশ জন লোককে সাক্ষী করাও খুব বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। যদি সাক্ষীর লোকজন কমানো যেত, তাহলে এই মামলা নিষ্পত্তি হতে আরও কম সময় লাগত। যে ঘটনা একেবারেই প্রকাশ্যে ঘটেছে সেখানে এত বেশি সংখ্যক সাক্ষী না নিয়ে কম সংখ্যক সাক্ষী নিলে মামলা দ্রুত সম্পন্ন হতো।
গ্রেনেড হামলার বিচার নিষ্পত্তি করতে পারলে আমরা জঙ্গিবাদের শিকড়ে আঘাত হানতে পারব। এতে এখানকার জঙ্গিবাদ সীমিত হলেও স্তিমিত হবে।
শেখ হাসিনাকে আক্রমণ মানেই বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, আশা-আকাক্সক্ষায় আঘাত হানা। তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার সম্পন্ন হলে জঙ্গিরা বড় ধরনের শিক্ষা পাবে।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন
